Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মৃত্যু সমন্বয়ের অভাবে, ধারণা বিমান সংস্থার

বিমানের ইঞ্জিনে ঢুকে গিয়ে কর্মীর মৃত্যু সমন্বয়ের অভাবেই হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছে এয়ার ইন্ডিয়া।

এই সেই এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান, যার ইঞ্জিনের ভিতর ঢুকে গিয়ে মৃত্যু হয় রবি সুব্রহ্মণ্যমের। ছবি: পিটিআই।

এই সেই এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান, যার ইঞ্জিনের ভিতর ঢুকে গিয়ে মৃত্যু হয় রবি সুব্রহ্মণ্যমের। ছবি: পিটিআই।

সায়নী ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:১৮
Share: Save:

বিমানের ইঞ্জিনে ঢুকে গিয়ে কর্মীর মৃত্যু সমন্বয়ের অভাবেই হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছে এয়ার ইন্ডিয়া।

বুধবার রাতে মুম্বই বিমানবন্দরে হায়দরাবাদগামী এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ৬১৯-এর চলন্ত ইঞ্জিনে ঢুকে গিয়ে মৃত্যু হয় রবি সুব্রহ্মণ্যম নামে সংস্থার এক প্রবীণ কর্মীর। ঘটনাস্থলে রবির সঙ্গে ছিলেন সহকর্মী ই টি শিন্দে-ও। একটি জলজ্যান্ত মানুষকে মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন হতে দেখে মাটিতে বসে পড়েছিলেন তিনি। তাতেই প্রাণ বেঁচে যায় তাঁর। বিমানটি ওড়ার আগে ট্যাক্সি বে ধরে রানওয়েতে যেতে গিয়েই ঘটে যায় এই দুর্ঘটনা।

১৯৯৫ সালে হায়দরাবাদে অনেকটা এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল। অবতরণের সময় রানওয়ের অত্যন্ত কাছে চলে আসায় বিমানের ইঞ্জিনে ঢুকে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিল এক নিরাপত্তাকর্মীর। তবে বিমান ওড়ার আগে এমন ঘটনা ভারতে আগে কখনও ঘটেছে বলে মনে করতে পারেননি অনেকেই। এই ঘটনায় বুধবারই বিমান পরিবহণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিজিসিএ তদন্ত শুরু করেছে। অভ্যন্তরীণ তদন্ত করছে এয়ার ইন্ডিয়াও। এ দিন বিমান সংস্থার এক মুখপাত্র বলেন, ‘‘আপাতত বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ওই বিমানের পাইলট ও কো-পাইলটকে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা বিমান ওড়াবেন না।’’ গাফিলতি কার, তা জানতে ককপিটের ব্ল্যাকবক্স খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিমান ওড়ার আগে যে সব নিয়মকানুন মানার কথা, ওই দিন তা অক্ষরে অক্ষরে মানা হয়নি বলেই সূত্রের খবর।

কী ধরনের নিয়মকানুন মেনে চলার কথা? একটি বেসরকারি বিমান সংস্থার পাইলট, ক্যাপ্টেন অরিন্দম দত্ত জানাচ্ছেন, যাত্রীরা উঠে পড়ার পর পার্কিং বে-তে দাঁড়িয়ে থাকা বিমানটিকে এগিয়ে পিছিয়ে ট্যাক্সি বে-র মুখোমুখি করিয়ে দেয় একটি ছোট গাড়ি। তাকে ‘টো-কার্ট’ বলে। বিমানের চাকায় লাগিয়ে দেওয়া হয় ধাতু বা রবারের তৈরি ত্রিভুজ আকারের ‘চোক’, যাতে বিমান গড়িয়ে না-যায়। এর পর বিমানের সামনের দিকে একটি প্লাগে হেডফোন লাগিয়ে মাইকের মাধ্যমে ককপিটে থাকা পাইলট ও কো-পাইলটের সঙ্গে কথা বলেন রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী। তিনিই পাইলটকে জানান সব ঠিক আছে কি না। তার পরে পাইলট এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-এর কাছ থেকে ইঞ্জিন চালু করার অনুমতি নিয়ে থাকেন। এটিসি ‘হ্যাঁ’ বললে ফের আর এক প্রস্ত অনুমতি নিতে হয় রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীদের কাছে। সেই অনুমতি মেলার পরই একে একে চালু করা হয় ইঞ্জিন। এ বার এটিসি বিমানকে রানওয়েতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার পর আবার কর্মীর চূড়ান্ত সবুজ সঙ্কেতের অপেক্ষা করেন পাইলট। স্বাভাবিক নিয়মে তখন বিমানের আশপাশে কিছু বা কেউ আছে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নেন কর্মীরা। তার পর প্লাগ থেকে হেডফোন খুলে বিমানের ডানা থেকে কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ ফুট দূরে (ককপিটের সামনে থেকে ৪৫ ডিগ্রি ডান দিকে অথবা বাঁ দিকে) গিয়ে দাঁড়ান তাঁরা। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে পাইলটকে বুড়ো আঙুল তুলে ‘রজার’ দেখানোর পরেই ট্যাক্সি বে ধরে এগোনো শুরু করার কথা বিমানের।

সূত্রের খবর, বুধবার এই পর্বেই কয়েকটি ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব ঘটেছিল বলে মনে করা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শী ই টি শিন্দের সঙ্গে দুর্ঘটনাটি নিয়ে কথা বলেছিলেন একটি বেসরকারি বিমান সংস্থার রক্ষণাবেক্ষণ ম্যানেজার প্রদীপ সিংহ রাওয়াত। প্রদীপ সংবাদমাধ্যমকে জানান, ঘটনার সময় রবির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন শিন্দে। প্রদীপের দাবি, শিন্দে তাঁকে বলেছেন— রবি ছিলেন বিমানের ডান দিকে, ইঞ্জিনের দিকে পিছন ঘুরে। চাকায় লাগানো ছিল না কোনও ‘চোক’। এটিসি থেকে রানওয়েতে যাওয়ার অনুমতি পেতেই ট্যাক্সি বে-র দিকে ঘুরতে শুরু করে বিমান। রবির হেডফোন তখনও জুড়ে বিমানের প্লাগের সঙ্গে। ইঞ্জিন ঘুরতে শুরু করে পুরোদমে। হাওয়ার সঙ্গে কানে হেডফোন সমেত রবিকে টেনে নেয় ডান দিকের ইঞ্জিনটি। পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল, শিন্দে ঢুকে যেতে পারতেন বাঁ দিকের ইঞ্জিনে। কিন্তু রবিকে দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে মাটিতে বসে পড়ায় বেঁচে যান। প্রদীপের কাছে শিন্দের অভিযোগ, এটিসি-র অনুমতি পাওয়ার পর তাঁদের অনুমতি নেননি পাইলট, কো-পাইলটের কেউই। ট্যাক্সি বে দিয়ে যাওয়ার সময় ইঞ্জিনের যে ক্ষমতা থাকার কথা, বুধবার তার চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় ইঞ্জিন চালু করা হয়েছিল বলেও তাঁর দাবি।

কর্মীদের সঙ্গে পাইলটদের সমন্বয়ের অভাবকে দায়ী করেছেন এয়ারলাইন্স অপারেটিং কমিটির চেয়ারম্যান সরবেশ গুপ্তও। বৃহস্পতিবার তিনি জানান, ককপিট থেকে বিমানের সামনের চাকা অর্থাৎ নোজ হুইলের কাছাকাছি কিছু দেখা যায় না। ফলে ককপিটে উঠে যাওয়ার পর এটিসি এবং রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীদের অনুমতির ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় পাইলট আর কো-পাইলটকে। তখন নিজেদের মধ্যে সমন্বয় রাখাটা খুব জরুরি। তিনি বলেন, ‘‘কয়েকটি বিষয় নিয়ে ধন্দ রয়েই যাচ্ছে। যেমন, বিমানের চাকায় চোক লাগানো ছিল কি না। বিমান পার্কিং ব্রেকে দাঁড় করানো ছিল কি না। এটিসি-র অনুমতির পর দূরত্বে দাঁড়ানো কর্মীর ‘থাম্বস আপ’ না দেখেই পাইলট বিমান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কি না। সব দিক খতিয়ে দেখছে ডিজিসিএ।’’

এই ঘটনায় আগেই দুঃখপ্রকাশ করেছেন এয়ার ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান অশ্বিনী লোহিয়া। এ দিন মৃত কর্মীর পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি ওই বিমান সংস্থায় একটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘কার গাফিলতিতে এমন হল, তদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত তা স্পষ্ট বলা যাবে না। এত ভয়াবহ মৃত্যু যে ময়নাতদন্তের জন্য দেহাংশও পাঠানো যায়নি। প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, নিয়মকানুন না মানার ফলেই এমন ঘটেছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE