Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বাইশ গজে বড় মোদীকে গুগলি কংগ্রেসের

ক্রিকেট দুর্নীতির পিচে দুই প্রান্তে দুই মোদীকে দাঁড় করিয়ে এ বার গুগলি ছুড়ল কংগ্রেস! তাদের দাবি, নরেন্দ্র মোদী ও ললিত মোদী পরস্পরের ঘনিষ্ঠ শুধু নন, বাইশ গজে দুর্নীতির খেলায় তাঁরা একই টিমে জুটি বেঁধে ব্যাট করেছেন এক সময়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৪৪
Share: Save:

ক্রিকেট দুর্নীতির পিচে দুই প্রান্তে দুই মোদীকে দাঁড় করিয়ে এ বার গুগলি ছুড়ল কংগ্রেস! তাদের দাবি, নরেন্দ্র মোদী ও ললিত মোদী পরস্পরের ঘনিষ্ঠ শুধু নন, বাইশ গজে দুর্নীতির খেলায় তাঁরা একই টিমে জুটি বেঁধে ব্যাট করেছেন এক সময়। এবং সেই কারণেই বসুন্ধরা রাজে বা সুষমা স্বরাজের ইস্তফার দাবি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সংসদের কাজকর্ম চলতে না দেওয়ার জন্য কার্যত প্রথম থেকেই মোদী সরকারকে দায়ী করে আসছে কংগ্রেস। আজ খোদ নরেন্দ্র মোদীকেই ক্রিকেট-দুর্নীতির অভিযোগে গাঁথতে চাইল তাঁরা। এবং এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির নামও এই প্রথম জড়াতে চেয়েছে কংগ্রেস।

সনিয়া ও রাহুল গাঁধী বুঝতে পারছেন, লোকসভা অচল রাখার জন্য পাল্টা চাপ তৈরি হচ্ছে তাঁদের বিরুদ্ধে। পণ্য পরিষেবা কর (জিএসটি) বিলটি কাল রাজ্যসভার আলোচ্যসূচিতে রেখে সরকার শিল্প-বণিকমহলকে বার্তা দিয়েছে, জিএসটি বিলের জন্য দরকারে যৌথ অধিবেশন ডাকার কথাও ভাবছে সরকার। কারণ তারা সংস্কার চায়। কংগ্রেসই সংসদ অচল রেখে সংস্কারের পথ আটকাচ্ছে। কংগ্রেসই এক সময় পণ্য পরিষেবা কর (জিএসটি) চালু করতে বিল এনেছিল। এখন তারাই লোকসভায় পাশ হওয়া বিলটির পথ আটকে রেখেছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এ নিয়ে আজও একদফা তুলোধোনা করেছেন কংগ্রেস নেতৃত্বকে। আগামিকাল সনিয়া গাঁধীর বাড়ির সামনে গিয়ে বিজেপি কর্মীরা জিএসটি বিলের পথ আটকে রাখার জন্য তাঁর জবাবদিহি চাইবেন।

কংগ্রেসকে এটাও ভাবতে হচ্ছে, ললিত-কাণ্ডে সুষমা-বসুন্ধরা ও ব্যপম-কাণ্ডে শিবরাজ সিংহ চৌহানের ইস্তফার দাবির মুখে আদৌ পিছু হটতে রাজি হচ্ছেন না মোদী। উল্টে তিনি বসুন্ধরা ও শিবরাজরা তাঁদের রাজ্যে কত উন্নয়ন ঘটিয়েছেন তারই খতিয়ান তুলে ধরছেন। অথচ সংসদ অচল করে রাখার প্রশ্নে বিরোধীরাও আর আগের মতো এককাট্টা নয়। তৃণমূল আগেই জানিয়েছে, তারা সংসদে আলোচনা চায়। সুর পাল্টেছে মুলায়ম সিংহ যাদবের সমাজবাদী পার্টিও। সংসদ অচল রাখার প্রশ্নে, কংগ্রেসের অন্দরেও বিভাজন তৈরির চেষ্টা চলছে। যে কারণে জেটলি আজ সরাসরি নিশানা করেন সনিয়া ও রাহুল গাঁধীকে। তাঁর বক্তব্য, কংগ্রেসেরও অনেকে চান সংসদ চলুক। স্রেফ দুই গাঁধীই সংসদীয় গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে রেখেছেন।

এই পাল্টা চাপ উড়িয়ে দিতে কংগ্রেসের রণকৌশল হল, মন্ত্রীদের ইস্তফা যখন হচ্ছেই না, তখন এর সুযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি যথা সম্ভব মলিন করার চেষ্টা করো। যে কারণে, প্রধানমন্ত্রীকে বিঁধে কপিল সিব্বল আজ প্রশ্ন ছোড়েন, ‘‘মোদী-মোদী যুগলবন্দির গোপন রহস্যটা কী? সেটা বলতে মোদীজির আপত্তি কোথায়? (মোদী-মোদীকি যুগলবন্দি কা রাজ কেয়া হ্যায়/ মোদীজি বোলনে মে অ্যাতরাজ কেয়া হ্যায়?’’

অবশ্য শুধু প্রশ্ন নয়, বেশ কিছু তারিখ, ললিত মোদীর ইমেলের প্রতিলিপি ও ফোনের ‘কল ডিটেল’ তুলে ধরে কপিল আজ সেই গোপন রহস্য দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন বেশ রসিয়ে রসিয়ে। কপিলের বক্তব্য, ললিত আইপিএলের চেয়ারম্যান থাকার সময় তাঁর সঙ্গে গুজরাত ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন সভাপতি নরেন্দ্র মোদী ও সহসভাপতি অমিত শাহের যথেষ্ট ‘দহরম মহরম’ ছিল। এবং দুর্নীতির অংশীদার বড় মোদীই আসলে আড়াল করছেন ছোট মোদীকে। ললিতকে ব্রিটিশ ভিসা পাইয়ে দেওয়ার বিষয়টি নির্ঘাত তাঁর গোচরে ছিল। আর সেই কারণেই সুষমার ইস্তফার দাবি মানার অবস্থাতেই নেই তিনি। কংগ্রেসের দাবি, দুই মোদীর অশুভ আঁতাঁত ও লেনদেন খতিয়ে দেখতে তদন্ত করাতে হবে।

কপিল এ দিন জানান, ২০০৯-এর ১৫ সেপ্টেম্বর নরেন্দ্র মোদী গুজরাত ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও অমিত শাহ সহসভাপতি নির্বাচিত হন। সে দিনই মুম্বইয়ে বিসিসিআই-এর মিটিংয়ে যোগ দেন, মোদী-অমিত। তাঁরা আবেদন করেন, রাজস্থান রয়্যালসের চারটি খেলা আমদাবাদের মোতেরা স্টেডিয়ামে ফেলতে হবে। রাজস্থান রয়্যালসের অন্যতম মালিক হলেন ললিত মোদীর ভগ্নিপতি শান্তনু চারি। পর দিন শান্তনু ললিতকে একটি ইমেল পাঠান। তাতে তিনি লেখেন, নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তিনি বিশেষ সম্পর্ক তৈরি করতে চান। ললিত যেন তাঁকে সাহায্য করেন। রাতেই জবাব দেন ললিত। লেখেন, পরের রবিবার তিনি নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করবেন। ‘‘উনি (নরেন্দ্র মোদী) আমার খুবই ঘনিষ্ঠ।’’ এর পর ঘরের মাঠ হিসেবে রাজস্থান রয়্যালসের ৪টি খেলা হয় মোতেরায়।

কপিলের কথায়, এটা সবে শুরু। আসল খেলা শুরু হয় পরে। ২০০৯-এর ডিসেম্বরে আইপিএল দু’টি নতুন টিম ঢোকানোর কথা ছিল। এ জন্য দরপত্র হাঁকা হয়। এরই মাঝে মোতেরা স্টেডিয়ামে ললিতের সঙ্গে শিল্পপতি গৌতম আদানির একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করিয়ে দেন নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ। এর পরই, দরপত্রে ললিত দু’টি নতুন শর্ত ঢোকান। এক, ফ্র্যাঞ্চাইজির জন্য আবেদন করতে হলে সংস্থার আর্থিক মূল্য একশো কোটি ডলার হতে হবে। দুই, ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি রাখতে হবে ৪৬০ কোটি টাকা। কপিলের দাবি, নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি আদানি ও ভিডিওকনকে সাহায্য করার জন্যই এই শর্ত ঢোকানো হয়। পরে এ নিয়ে আপত্তি উঠলে তদন্ত শুরু হয়। জেটলি ছিলেন বিসিসিআই-এর ওই তদন্ত কমিটির সদস্য। সেই কমিটির রিপোর্টে ললিতের পদক্ষেপের সমালোচনা করা হয়। দুর্নীতির অভিযোগ করা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। মিটিং থেকে বেরিয়ে ললিত ফোন করেন অমিত শাহকে। তার কল ডিটেলও এ দিন প্রকাশ করেছেন কপিল। তাঁর প্রশ্ন, দুর্নীতির কথা জেনেও জেটলিরা তখন কেন তা নিয়ে মামলা দায়ের করেননি?

কপিলের স্পষ্ট অভিযোগ, এ দিন পেশ করা তথ্য-প্রমাণেই দুই মোদীর সম্পর্ক প্রমাণিত। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ তখন সরকারি পদে ছিলেন। সরকারি পদের অপব্যবহার করে এক জন ব্যবসায়ীর ফায়দা করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে তাঁরাও দুর্নীতি করেছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধেও তাই তদন্ত হওয়া উচিত। জেটলি অবশ্য এ ব্যাপারে আজ কোনও জবাব দেননি।

আজও লোকসভা ও রাজ্যসভা দুই কক্ষেই মন্ত্রীদের ইস্তফা চেয়ে হল্লা করে কংগ্রেস। এমনকী, স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে লোকসভায় ফের প্ল্যাকার্ড তুলে স্লোগান দেন। পরে সংসদের বাইরে রাহুল গাঁধী ফের চোয়াল শক্ত করে জানিয়ে দেন, ‘‘ললিত মোদীর থেকে সুষমা স্বরাজ কত টাকা নিয়েছেন জানিয়ে দিলেই সংসদ চলতে পারে!’’

প্রশ্ন হল, দেড় মাস আগেই কংগ্রেস অভিযোগ তুলেছিল ললিতকে ব্রিটিশ ভিসা পাইয়ে দিতে সুষমা সাহায্য করেছেন। এর এত দিন পরে আজ কেন হঠাৎ আইপিএল প্রসঙ্গ টেনে আনল কংগ্রেস? কপিল এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘‘সত্যিই ব্যাপারটা আগে জানতাম না। কাগজ পত্র দু’দিন হল হাতে পেয়েছি।’’

কিন্তু রাজনৈতিক সূত্রে খবর, সুষমা-বসুন্ধরার ইস্তফার দাবিতে কংগ্রেস টানা অচল করে রেখেছে সংসদ। আর অধিবেশন চালাতে পাল্টা ছক কষেছে শাসক দলও। মুলায়ম-তৃণমূল বেসুরো গাওয়ায় চিন্তা আরও বেড়ে যায় সনিয়ার। এই পরিস্থিতিতে সনিয়া আজ তৃণমূল এবং জেডিইউ নেতাদের বলেন, ‘‘শুনছি ওঁরা (বিজেপি) নাকি বিজেডি বা এডিএমকের মাধ্যমে লোকসভায় আইপিএল নিয়ে একটা আলোচনা শুরু করাতে চাইছে। আর তার সূত্রে সুষমা-বসুন্ধরার প্রসঙ্গ টেনে দায়সারা ভাবে আলোচনা করেই হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছে! এই চেষ্টা কিন্তু রুখে দিতে হবে।’’ মনে করা হচ্ছে, সরকারের কৌশল ভেস্তে দিতেই কংগ্রেস আজ বোমা ফাটাল বড় মোদীর উদ্দেশে। বুঝিয়ে দিতে চাইল, আইপিএল নিয়ে আলোচনা হলে টানাহেঁচড়া হবে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়েও। এবার বুঝে নিক বিজেপি!

বেসুরো মমতা, মুলায়ম

নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন সনিয়া গাঁধী। কিন্তু সংসদ অচল করতে কংগ্রেসের পথে হাঁটছেন না মুলায়ম সিংহ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা। বাদল অধিবেশন শেষ হতে বাকি তিন দিন। এই সময়েই বিরোধী শিবিরের ভাঙনের ছবি স্পষ্ট। এ সবের পিছনে প্রধান ভূমিকা সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিংহ যাদবের। অনেকেই বলছেন, মোদী সরকারের সঙ্গে ভারসাম্য রাখার খেলাতেই সনিয়ার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা মমতা, মুলায়মের। লোকসভার মধ্যেও মুলায়ম-সনিয়ার মতভেদ আজ সামনে এসেছে। সাসপেন্ড পঁচিশ জন সাংসদ আজ লোকসভায় ফেরেন। তার পরেই অধিবেশন অচল করতে ওয়েলে নেমে হইচই করছিলেন কংগ্রেসের সাংসদরা। এই সময়েই মুলায়ম বলতে ওঠেন। তাঁর প্রস্তাব, অচলাবস্থা কাটাতে বৈঠক ডাকা উচিত স্পিকারের। তৃণমূলের লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানান কংগ্রেসের পথে হাঁটতে রাজি নন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE