Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কোর্টের রায়ে সুর বদল কংগ্রেস-বিজেপির

হাওয়া যে দিকে, রাজনীতির কারবারিরাও সে দিকে। তারা কেউই যে বাকস্বাধীনতার বিপক্ষে নয়, তা প্রমাণ করতে এখন তত্‌পর সব রাজনৈতিক দল।ফেসবুক-টুইটারে রসিকতা করার অপরাধে কাউকে যাতে জেলে পোরা যেতে পারে, তার বন্দোবস্ত করেছিল ইউপিএ সরকার। বিজেপিও সে সময় তাতে কোনও আপত্তি করেনি। এখন সুপ্রিম কোর্ট তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা বাতিল করে দেওয়ার পরে দু’দলই নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলতে মরিয়া। কংগ্রেস ও বিজেপি, দু’দলের নেতারাই গত কালের রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন। কে কত বেশি বাক্স্বাধীনতার পক্ষে, দু’দলই এখন তা প্রমাণ করতে ব্যস্ত।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৫ ০৫:২৭
Share: Save:

হাওয়া যে দিকে, রাজনীতির কারবারিরাও সে দিকে। তারা কেউই যে বাকস্বাধীনতার বিপক্ষে নয়, তা প্রমাণ করতে এখন তত্‌পর সব রাজনৈতিক দল।

ফেসবুক-টুইটারে রসিকতা করার অপরাধে কাউকে যাতে জেলে পোরা যেতে পারে, তার বন্দোবস্ত করেছিল ইউপিএ সরকার। বিজেপিও সে সময় তাতে কোনও আপত্তি করেনি। এখন সুপ্রিম কোর্ট তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা বাতিল করে দেওয়ার পরে দু’দলই নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলতে মরিয়া। কংগ্রেস ও বিজেপি, দু’দলের নেতারাই গত কালের রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন। কে কত বেশি বাক্স্বাধীনতার পক্ষে, দু’দলই এখন তা প্রমাণ করতে ব্যস্ত।

দু’দলেই দুঁদে আইনজীবী বলে পরিচিত রাজনৈতিক নেতাদের অভাব নেই। এক দিকে পি চিদম্বরম, কপিল সিব্বল, সলমন খুরশিদ, তো অন্য দিকে অরুণ জেটলি, রবিশঙ্কর প্রসাদ। প্রশ্ন হল, ইউপিএ-সরকারের জমানায় যখন তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সংশোধন করে ৬৬এ ধারা ঢোকানো হয়েছিল, তখন এই নেতারা কী করছিলেন? কেন তাঁরা বুঝতে পারেননি যে, আইনের এই ধারার অপব্যবহার হতে পারে? আমেরিকা বা ব্রিটেনের মতো দেশে এই ধরনের আইন নেই। দু’দেশেই বাক্‌স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের আত্মসংযমের উপর ভরসা রাখা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়েও সে কথা উল্লেখ করেছেন দুই বিচারপতি জে চেলমেশ্বর ও বিচারপতি রোহিংটন ফলি নরিম্যান। দু’দেশের আইন ও আদালতের রায় তুলে ধরে বিচারপতিরা দেখিয়েছেন, কতখানি অস্পষ্ট শব্দ রেখে দিয়ে অপব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছিল এই আইনে।

আমেরিকা-ব্রিটেনের মতো তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর দেশে যার প্রয়োজন পড়ল না, সেখানে হঠাত্‌ এ দেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এমন ধারা ঢোকানোর প্রয়োজন কেন পড়েছিল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে যখন সংসদে এই আইনি সংশোধনী বিল পাশ হচ্ছে, সে সময় তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী ছিলেন এ রাজা। পরে যে মন্ত্রকের দায়িত্বে আসেন কপিল সিব্বল। এবং এ রাজার তৈরি আইনকে নিজের সন্তানের মতো কোলে তুলে নেন। এই আইনের কড়া সমালোচনা হলেও সিব্বল আইনের পক্ষে জোরালো সওয়াল করে গিয়েছেন। পি চিদম্বরম সে সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ইতিহাস বলছে, ২২ ডিসেম্বর লোকসভায় আধ ঘণ্টারও কম সময়ে এই বিল পাশ হয়ে যায়। পরের দিন রাজ্যসভাতেও কোনও আলোচনা ছাড়াই বিলটি পাশ হয়ে গিয়েছিল। বর্তমান অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা ছিলেন। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ তখন রাজ্যসভার সদস্য। সে সময় তিনি তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যও ছিলেন। লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিল পাশ হওয়ার আগে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে এই বিলটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। স্থায়ী কমিটিও ৬৬এ ধারার অপব্যবহারের আশঙ্কার কথা ভেবে দেখেনি।

এখন তাঁরা কী বলছেন? চিদম্বরম বলেছেন, “আইনের এই ধারাটি গোড়া থেকেই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। অপব্যবহারের সুযোগ ছিল, হয়েওছে।” সিব্বল সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “আমি কোনও দায় ঝেড়ে ফেলছি না। শীর্ষ আদালতের রায়কে স্বীকার করতে হবে।” তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছেন, “আমরা বরাবরই বাক্স্বাধীনতার পক্ষে। ইউপিএ-সরকার এই আইন করে বাক্স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা করেছিল। আমরা সেই অবস্থানকে সমর্থন করিনি।” বাস্তব চিত্র হল, মোদী সরকারও সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে আইনের এই ধারা রেখে দেওয়ার পক্ষেই যুক্তি দিয়েছিল।

কেন কারও মন্তব্য আপত্তিকর মনে হলেই তাকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা তৈরি করেছিল মনমোহন-সরকার?

তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক সূত্রের খবর, দয়ানিধি মারানের সময় এই আইন নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। তার পর ওই মন্ত্রকে আসেন এ রাজা। তিনি আইন মন্ত্রকের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেন। সে সময় আইনমন্ত্রী ছিলেন হংসরাজ ভরদ্বাজ। যুক্তি দেওয়া হয়, মহিলাদের বিরুদ্ধে সাইবার অপরাধ, বিশেষ করে মহিলাদের অশালীন এসএমএস পাঠানোর মতো ঘটনা বন্ধ করার জন্য এই আইন জরুরি।

কেন কংগ্রেসের আইনজীবী মন্ত্রীরা সে সময় চোখ বুজে ছিলেন? কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সূর্যেওয়ালা আজ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, অনলাইনে অপরাধ রুখতে এই আইন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সে সময় ফেসবুক-টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া এই চেহারায় আসেনি। কাজেই ফেসবুক-টুইটারে কেউ রসিকতা করেও গ্রেফতার হতে পারেন, তা বোঝা যায়নি। রণদীপের যুক্তি, অরুণ জেটলি নিজেই সে সময় এই আইনের যৌক্তিকতার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। আজ বিজেপির তরফে পাল্টা দাবি করা হয়েছে, ২০১২ সালে যখন রাজ্যসভায় এই আইন প্রয়োগের নিয়মবিধি নিয়ে আলোচনা হয়, সে সময় জেটলি এই আইনের অপব্যবহার সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক করেছিলেন। কংগ্রেসের পাল্টা যুক্তি, আইনে যথেষ্ট রক্ষাকবচ রাখা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট তাকে যথেষ্ট বলে মনে করেনি। মোদী সরকারের ঘাড়ে পাল্টা দায় চাপিয়ে রণদীপের যুক্তি, “এর পর নতুন সরকারেরও দায়িত্ব ছিল, ফের ওই আইনের পর্যালোচনা করে প্রয়োজনে আইনের সেংশাধন করা।”

মোদী সরকার তা করেনি। কিন্তু লোকসভা বা রাজ্যসভায় আইন পাশের সময় কেন এর বিরোধিতা করা হয়নি? রবিশঙ্কর প্রসাদের যুক্তি, হই-হট্টগোলের মধ্যে বিল পাশ হয়েছিল। তখন সবে মুম্বইয়ের ২৬/১১-র হামলা হয়েছে। আইপিএস অফিসার হেমন্ত কারকারের নিহত হওয়ার ঘটনার তদন্ত দাবি করেছেন কংগ্রেসের মন্ত্রী এ আর আন্তুলে। সেই নিয়েই বিতর্ক চলছিল। বাক্স্বাধীনতার বিল নিয়ে কেউ কোনও কথা বলেনি।

কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের পরে গোটা দেশে এখন বাক্স্বাধীনতার হওয়া। আর হাওয়া বুঝে কংগ্রেস, বিজেপি সব নেতাই এখন বাক্স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করতে শুরু করেছেন।

ঠিক হাওয়া-মোরগের মতো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

congress BJP facebook 66a Supreme court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE