Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

নিয়োগ ঘিরে শিক্ষাকর্তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের

আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন কর্মকর্তার নিযুক্তি ঘিরে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত দানা বেঁধেছে। রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের চিঠিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অসমের উচ্চশিক্ষা অধিকর্তা জানতে চেয়েছেন— নিয়োগকর্তার অনুমোদন ছাড়া কী করে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ করা হল?

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলচর শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৫ ০৩:২০
Share: Save:

আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন কর্মকর্তার নিযুক্তি ঘিরে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত দানা বেঁধেছে।

রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের চিঠিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অসমের উচ্চশিক্ষা অধিকর্তা জানতে চেয়েছেন— নিয়োগকর্তার অনুমোদন ছাড়া কী করে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ করা হল? উপাচার্যের বক্তব্য, ‘‘অধিকর্তা কী ভাবে আমাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করেন!’’ রাজ্য সরকারি কলেজ থেকে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনিযুক্ত তিন জনকেও কারণ দর্শাতে বলেছেন শিক্ষা অধিকর্তা ফণীন্দ্র জিডুং। তাঁরা কী জবাব দেন, এখন সে দিকে তাকিয়ে সবাই। রয়েছে উৎকণ্ঠাও, ফের কি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদগুলি শূন্য হতে চলেছে?

যে তিনটি পদ নিয়ে বিবাদ বেঁধেছে, সেগুলি হল— রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও কলেজ ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের ডিরেক্টর। তার মধ্যে প্রথম দু’টি বিধিবদ্ধ। তিন পদের জন্য গত এপ্রিলে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। গুরুচরণ কলেজের সহযোগী অধ্যাপক সঞ্জীব ভট্টাচার্য রেজিস্ট্রার পদে নিযুক্ত হন। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কাবুগঞ্জ জনতা কলেজের অধ্যক্ষ সুপ্রবীর দত্তরায়। কলেজ ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদে কাছাড় কলেজের অধ্যক্ষ দেবাশিস করকে মনোনীত করা হয়। সঞ্জীববাবু ও দেবাশিসবাবু ১ মে নতুন কাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সুপ্রবীরবাবু যোগ দেন ১৫ মে। তখনও উচ্চশিক্ষা অধিকর্তা জিডুং তাঁদের নতুন নিযুক্তির কথা জানতেন না। জানতেন না কলেজ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথাও। বিষয়টি তাঁর নজরে আসে, কলেজ পরিচালন সমিতিগুলি যখন তাঁদের সিদ্ধান্ত নিয়ে অধিকর্তার অনুমোদন চান।

উচ্চশিক্ষা দফতরের চাকরি থেকে লিয়েন (নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনে পুরনো কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসা) নিয়ে চলে গেলেন তিন-তিন জন। কিন্তু শিক্ষা অধিকর্তাকে কিছুই জানালেন না, এমন ব্যাপার মেনে নিতে পারেননি জিডুং। তিনি প্রশ্ন তোলেন— তাঁদের নিয়োগকর্তা কে, অধিকর্তা না কি পরিচালন সমিতি? তিনি তাঁদের ছাড়তে রাজি নন বলেও ইঙ্গিত দেন। একই সঙ্গে দুটি চাকরি করার অভিযোগ তুলে জানতে চেয়েছেন, ওই তিন জনের বিরুদ্ধে কেন সরকারি নিয়ম অনুসারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে তিনি লিখেছেন, নিয়োগকর্তার অনুমতি ছাড়া যাঁরা কাজে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। উপাচার্যকে জানানোর জন্য প্রতিলিপি পাঠানো হয় তাঁর ব্যক্তিগত সহায়ককে। সঞ্জীববাবুই নতুন রেজিস্ট্রার বলে চিঠিটি পৌঁছয় তাঁরই হাতে। জিডুঙের চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও ‘কারণ দর্শানোর নোটিস’ এখনও হাতে পাননি বলে তিনি জানিয়েছেন। দুই জায়গায় চাকরির অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘এ সব প্রশ্ন আমাকে কেন কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি বা অধ্যক্ষকে জিজ্ঞেস করলেই ভাল। তাঁরাই তো আমাকে লিয়েন দিয়েছেন, রিলিজ করেছেন।’

গুরুচরণ কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি সৌরীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমি সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের আগেই অধ্যক্ষা ছায়া রায় কুণ্ডু সঞ্জীববাবুকে এনওসি, লিয়েন দিয়ে দেন। সে অনুসারে তিনি ১ মে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ২৮ মে পরিচালন সমিতির বৈঠকে আমি রিলিজ অর্ডারে সই করি। এও বলা হয়েছে, অধিকর্তার অনুমোদন পেলেই এই নির্দেশ কার্যকর হবে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এ ভাবেই এতকাল ধরে চলে আসছিল। অনুমোদনের ব্যাপারগুলি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কেউ কখনও এ নিয়ে আপত্তি তোলেননি। এখন এ ভাবে না চললে পরিচালন সমিতিগুলির কাছে স্পষ্ট নির্দেশিকা পাঠানো হোক।’’

কারণ দর্শানোর নোটিস বলতে না চাইলেও সুপ্রবীরবাবু স্বীকার করেছেন, অধিকর্তার চিঠি তিনি পেয়েছেন। যে সব বিষয় জানতে চাওয়া হয়েছে, সেগুলি তাঁর কাছে খুবই স্পষ্ট। ২০১১ সালের ৮ ডিসেম্বর পরিচালন সমিতি তাঁকে এনওসি দেওয়ার ব্যাপারে সভাপতিকে দায়িত্ব দেয়। ওই সিদ্ধান্ত অনুসারে সভাপতি তাঁকে এনওসি-লিয়েন দিয়েছেন। এর পরও তিনি অধিকর্তার অনুমতি চেয়ে ২৩ এপ্রিল চিঠি পাঠিয়েছেন। ২৮ এপ্রিল নিশ্চিত হন, চিঠিটি অধিকর্তার নজরে নেওয়া হয়েছে। তাঁর উত্তরের অপেক্ষায় তিনি ১ মে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেননি। দিয়েছেন ১৫ মে। সুপ্রবীরবাবুর কথায়, ‘‘চিঠি পাওয়ার এত দিন পরও যখন কোনও জবাব আসেনি, তখন ধরে নিই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার নিয়ে অধিকর্তার কোনও আপত্তি নেই।’’ দেবাশিসবাবু ফোন না ধরলেও উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২৩ মে তিনি অধিকর্তাকে একটি চিঠি লিখেছেন। তাতে জানিয়েছেন— তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্তির জন্য আবেদন করেন তখন পরিচালন সমিতির সভাপতি ছিলেন অপরাজিতা চৌধুরী। তিনিই তাঁকে এনওসি দেন। শর্ত ছিল, পরিচালন সমিতির সভায় তা অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। সেই হিসেবে ২৬ এপ্রিলের সভায় তাঁর এনওসি-র বিষয়টি অনুমোদিত হয়। এর পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি আসাম কলেজ এমপ্লয়িজ (প্রভিনসিয়ালাইজেশন) রুলস, ২০১০ সালের ২৪ ধারার কথা উল্লেখ করে দাবি করেন— এনওসি দেওয়া পরিচালন সমিতিরই কাজ। তবু বিষয়টি তাঁর নজরে না নেওয়ায় দেবাশিসবাবু অধিকর্তার কাছে দুঃখপ্রকাশ করেন।

কাছাড় কলেজ পরিচালন সমিতির বর্তমান সভাপতি বিজয়ভূষণ দাস জানিয়েছেন, ২৬ এপ্রিলের সভায় এ রকম কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। দেবাশিসবাবুর ২৪ ধারার দাবিও উচ্চশিক্ষা দফতরের সূত্রটি খারিজ করে দেন। তিনি বলেন, ‘‘২৪ নম্বর ধারায় এনওসি-র কথা রয়েছে বটে, তবে লিয়েন-এর উল্লেখ রয়েছে ২৩ নম্বর ধারায়। সেখানে বলা হয়েছে, পরিচালন সমিতি তো নয়ই, অধিকর্তাও লিয়েন মঞ্জুর করবেন না। তিনি প্রস্তাব দেবেন, মঞ্জুর করবে রাজ্য সরকার।’’ অধিকর্তার অনুমতি না নিয়ে সঞ্জীববাবু সহ দুই অধ্যক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক দেখা দেওয়ায় কলেজগুলিও পড়েছে সমস্যায়। পরিচালন সমিতি আগেই উপাধ্যক্ষদের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিযুক্ত করে। অধিকর্তা জিডুং তা মানতে নারাজ। পরে অবশ্য কাছাড় কলেজের উপাধ্যক্ষ কে লক্ষ্মীতন সিংহকে তিন মাসের জন্য অধ্যক্ষের কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। অধ্যক্ষ ফিরে এলে বা নতুন অধ্যক্ষ নিযুক্ত হলে তাঁকে সরে যাওয়ার কথা বলা হয়। তবে শুধু শৈক্ষিক দিক দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁকে। অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা থাকবে না বলে একই নির্দেশে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলার বিদ্যালয় পরিদর্শককে। তাও শুধু কাছাড় কলেজের জন্য। জনতা কলেজের বিষয়টি ঝুলেই রয়েছে। গত কাল পরিচালন সমিতি নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুভাষচন্দ্র নাথ ও অন্যান্য শিক্ষক-কর্মচারীরা এ নিয়ে মন্ত্রী গিরীন্দ্র মল্লিকের সঙ্গে দেখা করেন। অচলাবস্থা কাটাতে তাঁর হস্তক্ষেপ দাবি করেন। উপস্থিত ছিলেন কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি কল্পতরু নাথও। অধিকর্তার সঙ্গে কথা বলবেন বলে মন্ত্রী তাঁদের আশ্বস্ত করেছেন।

এই বিতর্ক উদ্বেগে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়কেও। শেষ পর্যন্ত অধিকর্তা জিডুং তাঁদের না ছাড়লে এবং তিন জনকেই যদি নিজেদের পুরনো জায়গায় ফিরে যেতে হয়, তা হলে উচ্চ পদগুলিতে আবার শূন্যতা দেখা দেবে। দফায় দফায় বিজ্ঞাপন দিয়ে, সাক্ষাৎকার নিয়েও রেজিস্ট্রার নিযুক্ত করা যাচ্ছিল না। সাড়ে তিন বছর ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালানো হয়। আবারও কি একই সঙ্কটে, প্রশ্ন উঠেছে এখনই।

কিন্তু নিয়োগকর্তার ছাড়পত্র ছাড়া কী করে নিযুক্ত করা হল তাঁদের? উপাচার্য সোমনাথ দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘তা দেখার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়। উচ্চশিক্ষা অধিকর্তার চিঠি পেয়ে তাঁদের সমস্ত কাগজপত্র আবার দেখেছি। নিযুক্তির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের যা যা প্রয়োজন সবই তাঁদের রয়েছে। এর পরও রাজ্য সরকারের কিছু বলার বা জানার থাকলে কেন্দ্রকে চিঠি লিখতে পারে। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক আমার কাছে জানতে চাইলে আমি তাঁদেরই সব জানাব।’’

এ নিয়ে কী ভাবছেন জিডুং? সোজা মন্তব্য, ‘‘সংবাদ মাধ্যমকে কিছু বলব না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE