দলিতদের আন্দোলনে জিগ্নেশ মেবাণী। ছবি: পিটিআই।
• ২০১৬-র ১ মে, মধ্যপ্রদেশের টিকমগড়। মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের সঙ্গে একই আসনে বসার ‘অপরাধে’ এক দলিত পঞ্চায়েত প্রধানকে বেধড়ক মার।
• হরিয়ানা। ঘোড়ায় চড়ার ‘অপরাধে’ দলিত যুবককে বেধড়ক পেটায় কয়েক জন রাজপুত যুবক।
• মধ্যপ্রদেশের ছত্তরপুর। সাজানো গোছানো গাড়ি চেপে বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন এক দলিত যুবক। রেয়াত করা হয়নি তাঁকেও।
• ফিরোজাবাদের নাগলা কেওয়াল গ্রাম। শহিদ হওয়া এক দলিত সেনার সৎকারের জায়গাটুকুও দেননি গ্রামের মাথারা।
• গুজরাতের ভাবনগর জেলা। ঘোড়ায় চড়ার ‘অপরাধে’ বছর একুশের দলিত যুবককে পিটিয়ে খুন।
উপরের উদাহরণগুলি নেহাতই কোনও ঘটনাক্রম নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘ডিজিটাল’ ভারতের সঙ্গে একই আসনে অনগ্রসর ভারত, দলিত ভারত, বিক্ষুব্ধ ভারতের ছবিটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। প্রতি দিনের জীবনের এই বঞ্চনা, জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া অধিকার এবং আত্মমর্যাদাবোধের অপচয় থেকে জন্ম নেওয়া পুঞ্জীভূত ক্ষোভই বিক্ষোভের দাবানল হয়ে ঝরে পড়েছে গোটা ভারতে। এই ক্ষোভ এক দিনে দানা বাঁধেনি। ছাই চাপা আগুনের মতোই ধিকি ধিকি জ্বলছিল বহু দিন ধরেই। বিস্ফোরণটা ঘটে শীর্ষ আদালতের একটি রায়কে কেন্দ্র করেই।
তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের উপর দীর্ঘ দিন ধরে হয়ে আসা অন্যায় ও অত্যাচার রোধ করার জন্য যে আইন রয়েছে, সে আইনের প্রয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে আদালত। প্রকাশ্যে বিক্ষোভের সূচনা হয় সেখান থেকেই। গত ২০ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে জানিয়েছিল, বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, তফসিলি জাতি ও জনজাতি নিপীড়ন প্রতিরোধ আইনের অপব্যবহার করা হয়। কোনও সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে এই ধরনের কোনও অভিযোগ উঠলে সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিয়োগ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ওই কর্মীকে গ্রেফতার করা যাবে না বলে জানিয়েছিল আদালত। অন্য দিকে, কোনও নাগরিকের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ উঠলে তাঁকে গ্রেফতারের আগে ডিএসপি পদমর্যাদার কোনও পুলিশ আধিকারিককে দিয়ে তদন্ত করানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তার মানে কী, এসসি এসটি নিপীড়ণ প্রতিরোধ আইন লঘু করা হল? যে দলিত তার অধিকার থেকে বঞ্চিত, সে কি আরও বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়ল না? শীর্ষ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে দুর্বৃত্ত যদি খোলা আকাশের নীচেই ঘুরে বেড়ায়, তা হলে কী ভাবে সুবিচার আশা করতে পারে এক দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ? পরোক্ষে উচ্চশ্রেণির তকমা আঁটা রাজনৈতিক নেতাদের ধামাধারীদেরই কি জয় হল না? প্রশ্নের পর প্রশ্ন। সুতোটা তৈরিই ছিল। এ বার শুধু ভয়, সংশয় এবং প্রশ্নেরা একের পর এক জড়ো হয়ে বিক্ষোভের মালা গাঁথল। ভারত বনধ হল। দেশ দেখল সীমাহীন তাণ্ডবের অগ্ন্যুত্পাত। কিন্তু অলক্ষ্যে, অনগ্রসর, অধিকারহৃত কিছু শ্রেণির অভিমানেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটল।
আরও পড়ুন- দলিত রায় স্থগিত হল না কোর্টে
আরও পড়ুন- দলিত বিক্ষোভে পাল্টা তির মোদীর
সেই সঙ্গে মাথাচাড়া দিল আর একটি প্রশ্ন। এত তাড়াতাড়ি এই বিচারবিভাগীয় সংশোধনের কী প্রয়োজন ছিল? বিচারপতি এ কে গয়াল এবং বিচারপতি উদয় উমেশ ললিতের বেঞ্চ জানাল, রায় মোটেই লঘু করা হয়নি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে দলিতদের। আইনের চাপে যাতে নিরাপরাধের শাস্তি না হয়, শুধুমাত্র খতিয়ে দেখা হয়েছে সেটাই। এখন প্রশ্ন জাগে, তা হলে নিরাপরাধ কারা? দেশের সর্বোচ্চ আদালত শুধুমাত্র আলোর দিকটাই দেখেছে। দেশের অন্ধকার দিকটার দিকে ফিরে তাকায়নি। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ১০ বছরে দলিত জনজাতির সংখ্যা বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। প্রতি ১৫ মিনিটে অন্তত এক জন দলিত নিপীড়ণের শিকার হন। প্রতি দিন অন্তত ৬ জন দলিত মা-বোন এ দেশে ধর্ষিতা হন। এক জন অভিযুক্তের আগাম জামিনের উপর নিষেধাজ্ঞাই যদি সরিয়ে ফেলা হয়, এক জন অভিযুক্ত সরকারি কর্মচারীকে যদি তাঁর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে গ্রেফতার করতে হয়, তা হলে আর মামলা করে লাভটা কী? যে দলিত নিত্যদিন বর্ণবৈষম্য, হয়রানি আর অত্যাচারের শিকার, তার ন্যায়বিচার লাভের প্রক্রিয়া তো অনেকটাই বিলম্বিত হবে! বলা বাহুল্য, সেটা হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কাই সবচেয়ে বেশি।
জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র (এনসিআরবি) রিপোর্ট বলছে, অপরাধের ওই খতিয়ান আসলে আংশিক সত্য। আসলে আরও অনেক বেশি নির্বিচারের শিকার হন দলিতেরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভয় এবং চাপের কারণে সে কথা তাঁরা লুকিয়ে যান। পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগও জমা পড়ে না, বা পড়লেও তার বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ করা হয় না। অনেকাংশেই নির্যাতনকারীদের দোষী সাব্যস্ত করা হয় না। ২০০৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তফসিলি জাতিদের (এসসি) উপর হওয়া নির্যাতনের বিরুদ্ধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে গড়ে ২৮.৮ শতাংশ। তফসিলি উপজাতিদের (এসটি) ক্ষেত্রে সেটা গড়ে ২৫.২ শতাংশ। অন্যায় উত্তরোত্তর বেড়েছে। সেই সঙ্গে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তাও। এক দিকে ব্রাহ্মণ্যবাদ, অন্য দিকে দলিতদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হিংসা ও সেই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর চর্চিত নীরবতা— সব মিলিয়েই সংঘাতটা বৃহত্তর আকার নেয়।
বিক্ষোভে জ্বলছে বাস। ছবি: পিটিআই
সংঘাতটা কিন্তু বাস্তব। হিংস্রতাও। দলিত-প্রশ্নে বিজেপি যে পন্থা গ্রহণ করেছে, এই সংঘাতে তারই প্রত্যাখ্যান ধ্বনিত। আরএসএস সূত্র বলছে, সঙ্ঘ পরিবারের মতাদর্শ হল— অবিভক্ত হিন্দু সমাজের পুনরুত্থান। দলিত সমাজকে হিন্দু সমাজের অঙ্গ হিসেবেই তারা দেখে। গোবিন্দাচার্য থেকে বিনয় কাটিয়ার বা উমা ভারতী পর্যন্ত বিভিন্ন দলিত নেতাকে সামনে এনে সঙ্ঘ পরিবার বার বার এই ‘ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র’র অপবাদ ঘোচাতে চেয়েছে। কিন্তু, এই পন্থা খুব একটা ধোপে টেকেনি। অন্ধ্রপ্রদেশের দলিত ছাত্রনেতা রোহিত ভেমুলার অস্বাভাবিক মৃত্যু থেকে গুজরাতের উনা বা সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁওয়ের জাতি সংঘর্ষের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ফারাকটা বিন্দুমাত্র কমেনি। মহারাষ্ট্রে মরাঠা বনাম দলিত বিরোধের প্রশ্নটিও তাই সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। নরেন্দ্র মোদীরা সম্ভবত টের পাচ্ছেন, তাঁদের মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু রাজনীতির প্রতিস্পর্ধী শক্তি হিসেবে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের দলিত আন্দোলনগুলি ক্রমেই এককাট্টা হচ্ছে এবং এমন কিছু প্রশ্ন তুলছে, যার উত্তর সরকারের কাছেও নেই।
তাই দিনকয়েক ধরে দলিতদের ক্ষোভের বিস্ফোরণকে শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখলে মস্ত ভুল হবে। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, পঞ্জাব, ঝাড়খণ্ড-সহ দেশ জুড়ে একাধিক রাজ্যে হিংসার আগুন জ্বলেছে। মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। আহতের সংখ্যা বহু। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজস্থানের এক দলিত বিধায়ক এবং এক প্রাক্তন দলিত বিধায়কের বাড়িতে। সংঘর্ষ ব্যাপক আকার নিয়েছে মেরঠে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পাশের এলাকা হাপুরেও। সেখানে রেল অবরোধ করেছেন হাজার দু’য়েক বিক্ষোভকারী। বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়েছে বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশাতেও।
বিক্ষোভ মিছিল। ছবি: পিটিআই
পরিস্থিতি যাতে আরও ঘোরালো না হয়ে উঠতে পারে, সে কথা বুঝেই তফসিলি জাতি ও জনজাতি নিপীড়ন প্রতিরোধ আইন লঘু না করার আর্জি নিয়ে তড়িঘড়ি সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশন দাখিল করেছে কেন্দ্র। রায় স্থগিত রাখতে অসম্মতি জানিয়ে আদালত বলেছে, রায়টিতে দলিতদের উদ্বেগের কারণ নেই। এটা শুধুমাত্র ১৯৮৯ সালের আইনটির অপব্যবহার বন্ধ করবার ব্যবস্থা। কিন্তু, অপব্যবহার বন্ধ করার নামে আইনটিকে ব্যবহার করাই যদি কঠিনতর হয়ে দাঁড়ায় তখন কি সেই ফাঁক গলে হিংস্রতা আরও বাড়বে না? মুখে যতই বৃহৎ হিন্দুত্বের বুলি আওড়াক বিজেপি, তাদের অন্তরে মনুবাদের আসন অটল। সেখানে দলিতের কোনও স্থান নেই। প্রতিস্পর্ধী শক্তিগুলিকে বৃহত্তর হিন্দুত্বের ছাতার তলায় নিয়ে আসতে গেলে যে উদারতা এবং সহনশীলতা প্রয়োজন, আরএসএস-বিজেপির তা নেই। নিম্নবর্ণের উচ্চাশা কোনও দিনই ঠাঁই পাবে না বা পেতে দেওয়া হবে না।
মহামান্য আদালত কি এই সত্যটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
লেখক এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy