Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
National News

স্বামী মুসলিম, কলকাতার মহিলার শ্রাদ্ধই করল না দিল্লির মন্দির

মৃত নিবেদিতা ঘটক রহমান। —নিজস্ব চিত্র

মৃত নিবেদিতা ঘটক রহমান। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৮ ১৯:১৪
Share: Save:

ভালবেসেই বিয়ে করেছিলেন এক ইসলাম ধর্মাবলম্বী যুবককে। কিন্তু, ধর্ম কখনই প্রাধান্য পায়নি দীর্ঘ কুড়ি বছরের দাম্পত্য জীবনে।

ধর্ম বিশ্বাসে তিনি সবসময়েই ছিলেন একজন হিন্দু। তাই শেষ ইচ্ছেও ছিল, অন্তেষ্ট্যি এবং শেষকৃত্য যেন হিন্দু রীতি মেনেই হয়। স্ত্রী-র এই বিশ্বাসকে সবসময়ে সম্মান দিয়ে এসেছেন তাঁর স্বামী। শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়েই রাজধানীর বুকে এক অপ্রত্যাশিত বাধার মুখে পড়েছেন কলকাতার ইমতিয়াজুর রহমান। শেষ পর্যন্ত দিল্লির অন্য একটি সংস্থা তাঁদের সাহায্যের আশ্বাস দিলেও, ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর কাটেনি ওই পরিবারের।

রাজ্য সরকারের বাণিজ্যিক কর দফতরের সহকারি কমিশনার ইমতিয়াজু্র। দীর্ঘ অসুস্থতার পর দিল্লির একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর স্ত্রী নিবেদিতা ঘটক রহমানের সম্প্রতি মৃত্যু হয়। স্ত্রীর ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়েই হিন্দু মতে দিল্লির নিগম বোধ ঘাটে দাহ করা হয় নিবাদিতার দেহ।

আরও পড়ুন: হেলিকপ্টার থেকে পুষ্পবৃষ্টি, শিব ভক্তদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বিতর্কে পুলিশকর্তারা

রীতি মেনে ঠিক ১১ দিনের মাথায় শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য ইমতিয়াজুর বেছে নেন দক্ষিণ দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক কালী মন্দিরকে। আর সেখান থেকেই অপ্রত্যাশিতভাবে বাধাটা আসে।নিবেদিতা অসুস্থ থাকাকালীন তাঁর লিভার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে। সেই সময় নিবেদিতাকে নিজের লিভারের অংশ দিয়েছিলেন তাঁর বোন কৃত্তিকা। এখনও তাঁর চিকিৎসা চলছে দিল্লিতে। গোটা ঘটনার সাক্ষী তিনি। বৃহস্পতিবার দিল্লি থেকে কৃত্তিকা বলেন,“সোমবার সন্ধ্যায় জামাইবাবু সি আর পার্ক কালীমন্দিরে গিয়েছিলেন শ্রাদ্ধের জন্য জায়গা বুকিং করতে। মন্দির কর্তৃপক্ষ আগামী রবিবারের জন্য বুকিংও নেন। তার জন্য নির্দিষ্ট ১ হাজার ৩০০ টাকা নিয়ে তাঁরা রশিদ দিয়েছিলেন।”

অভিযোগকারী ইমতিয়াজুর রহমান। —নিজস্ব চিত্র

কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তার ঘন্টাখানেক পর থেকে। ইমতিয়াজ বলেন, “আমার মোবাইলে মন্দির কর্তৃপক্ষ হঠাৎই ফোন করেন। তাঁরা বার বার আমার নাম জিজ্ঞাসা করেন। তখনই আমার সন্দেহ হয়।” কৃত্তিকাও সেই সময় সামনেই ছিলেন। তিনি বলেন,“এর পর আবার ওঁরা ফোন করে জানতে চান, নিবেদিতা ঘটকের কে হয় জামাইবাবু? প্রথমে ওঁদের ধারণা ছিল, সম্পর্কটা শ্বাশুড়ি-জামাইয়ের। কিন্তু জামাইবাবু পরিষ্কার জানান যে, তাঁর স্ত্রীর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হবে। আর সেই কাজ করবে তাঁদের একমাত্র মেয়ে ঈহিণী আম্বরীণ।”

তারপরেই মন্দিরের অফিস থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে তাঁরা ওই বুকিং দিতে পারবেন না। ইমতিয়াজুর বলেন,“ওঁরা সরাসরি কোনও কারণ দেখাননি। খালি বলেছিলেন, তাঁদের নাকি আগে থেকে কোনও বুকিং রয়েছে। আর সেই কারণেই তাঁরা বুকিং ক্যানসেল করতে বাধ্য হচ্ছেন। তখন আমি বলি, আমরা তো যখন গিয়েছিলাম, তখন তো আপনারা কোনও বুকিং নেই দেখেই আমাকে বুক করতে দিয়েছিলেন। তারপরেও কেন ক্যানসেল?প্রশ্ন করায় ফোনের ওপার থেকে জবাব আসে, আপনি যা বোঝার বুঝে নিন।”

আরও পড়ুন: উনিশের আগে আস্থা বাড়ল মোদি-শাহ জুটির, বিরোধীরা সেই ছন্নছাড়াই

বৃহস্পতিবার ইমতিয়াজুরের কথায় কোনও বিদ্বেষ ছিল না। তিনি বলেন,“আমি কালীমন্দির কর্তৃপক্ষকে কোনও দোষ দিচ্ছি না। হতেই পারে তাঁদের রীতি অনুসারে, আমার ধর্মের কারণে তাঁরা অনুমতি দিতে পারছেন না। কিন্তু সেটা তাঁরা প্রথমেই করলেন না কেন? বুকিংয়ের সময়তেই তো তাঁরা সবটাই জানতেন।”যদিও তা মানতে নারাজ কৃত্তিকা। তাঁর কাছে গোটা ব্যাপারটাই খুব অপ্রত্যাশিত। তিনি বলেন,“চিত্তরঞ্জন পার্ক দিল্লির অন্যতম অভিজাত এলাকা। এই সংস্থার সঙ্গে যারা যুক্ত, তাঁরা দিল্লি প্রবাসী অভিজাত মানুষ। সেখানে এই ঘটনা আমার কাছে খুব শকিং।”

সি আর পার্ক কালী মন্দির সোসাইটির অন্যতম কর্মকর্তা অলোক মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেন,“আমি দিল্লির বাইরে ছিলাম। আমাকে খতিয়ে দেখতে হবে কেন ক্যানসেল করা হয়েছে বুকিং।” তবে সোসাইটির সভাপতি অসিতাভ ভৌমিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘এই পরিচালন সমিতি দু’বছর অন্তর নির্বাচিত হয়। আমরা কেবল এই সোসাইটি চালাই। এখানকার মূল সিদ্ধান্ত নেন পুরোহিতরাই। হিন্দু রীতি ভেঙে আমরা কিছুর অনুমতি দিতে পারব না।’’

চিত্তরঞ্জন পার্ক কালী মন্দির সোসাইটি ফেরালেও, শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছেন সি আর পার্কেরই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন মেমোরিয়াল সোসাইটি। কৃত্তিকা বলেন, “ওঁরা কথা দিয়েছেন। ওঁদের চিত্তরঞ্জন ভবনেই রবিবার দিদির শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হবে। ওঁরাই পুরোহিতের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন।”

তিনি ইমতিয়াজুর আর তাঁর দিদির প্রথম জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “জামাইবাবু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্সি ভাষার ছাত্র। দিদি বাংলার। দিদি দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী স্কুলে পড়াতেন। আপাত অনেক পার্থক্য থাকলেও ওদের গড়িয়ার বাড়িতে সবসময়ে দেখেছি পরস্পরের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা।আর সেখানেই আঘাত আসায় জামাইবাবু ভেঙে পড়েছেন।” সেই পারস্পরিক সম্মান থেকেই একমাত্র সন্তান ঈহিণী আম্বরীণের নাম রেখেছেন দু’জন মিলেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hindu Muslim Temple
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE