কৈলাস এবং আদিত্যনাথ
কাল বলেছিলেন ‘দেশদ্রোহী’। আজ সেই টুইট প্রত্যাহারের ঘোষণা করে সুপারস্টার শাহরুখ খানকে অমিতাভ বচ্চনের পর সবথেকে ‘জনপ্রিয় অভিনেতা’ বলে ক্ষত মেরামতের চেষ্টা করলেন বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়। কিন্তু, তিনি ইতি টানলেও বিজেপির আর সাংসদ যোগী আদিত্যনাথ আরও এক ধাপ এগিয়ে শাহরুখকে পাক সন্ত্রাসবাদী হাফিজ সঈদের সঙ্গে তুলনা করে বসলেন। ঘটনাচক্রে সেই হাফিজ সঈদের টুইটে আজ ভেসে উঠল শাহরুখের প্রতি সহমর্মিতা। তার কথায়, শাহরুখ-সহ ভারতের যে কোনও মুসলমান বৈষম্যের মুখোমুখি হলে পাকিস্তানে স্বাগত।
ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই ভারতের রাজনীতির উত্তাপ বাড়ছে। একে একে লেখক-শিল্পী-শিক্ষাবিদ-ঐতিহাসিকরা প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। নরেন্দ্র মোদীর ‘অসহিষ্ণু’ মুখ তুলে ধরতে রাজপথেও নেমেছেন বিরোধী কংগ্রেস দলের নেত্রী সনিয়া গাঁধী। আর এর মোকাবিলায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ৮৪-র শিখ দাঙ্গার প্রসঙ্গ টেনে এনে পাল্টা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতার অভিযোগের সুরটি বেঁধে দিয়েছেন। তার পর থেকে বিজেপির একাধিক মন্ত্রী ও নেতারা প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধেই সুর চড়াতে শুরু করেছেন। সেই সূত্র ধরে শাহরুখের মুখে অসহিষ্ণুতার কথা শুনে সরব হয়েছিলেন বিজেপির সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয়। বিজেপি নেতৃত্বের চাপেই আজ তাঁকে পিছু হঠতে হয়। কিন্তু তাতেও বিজেপি নেতাদের থামানো যাচ্ছে কোথায়?
এখানেই প্রশ্ন, তা হলে কি এখন দলের নেতারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের? না কি এর পিছনে দলের নেতৃত্বেরই প্রচ্ছন্ন মদত রয়েছে?
বিজেপির এক শীর্ষ নেতার কথায়, আসলে দু’টিই বাস্তব। দাদরির ঘটনার পর থেকেই দেশজুড়ে একটি অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি করার পিছনে কংগ্রেস ও বামপন্থীদের সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র রচনা করা হচ্ছে। এ যাবৎ যত জন পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্রতিবাদ করছেন। এঁরা অতীতেও বিজেপির বিরোধিতা করতেন। দেশে এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে সনিয়া গাঁধীকে রাজপথে নেমে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত পদযাত্রা করতে হবে। মোদী সরকারের মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরের মতে, ‘‘একটি ঘটনার পিছনেও বিজেপি কোনও ভাবে দায়ী নয়। প্রতিটি ঘটনা ঘটেছে কংগ্রেস কিংবা কংগ্রেসের বন্ধু দলের শাসিত রাজ্যে। কিন্তু দোষ পড়ছে বিজেপির উপরে। আর সেটিকে ঘিরেই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে একটি সংগঠিত প্রচার করা হচ্ছে। ফলে এর পাল্টা মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে।’’
আর সে কারণেই খোদ প্রধানমন্ত্রী শিখ দাঙ্গার প্রসঙ্গ তুলে বা দলের অন্য নেতারা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উচ্ছেদ থেকে শুরু করে অন্য ঘটনাকে সামনে নিয়ে এসে কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই পাল্টা অসহিষ্ণুতার অভিযোগ তুলেছেন। বিজেপির শীর্ষ সূত্রের মতে, কৈলাস বিজয়বর্গীয় এই মুহূর্তে অমিত শাহের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ নেতা। ফলে তিনি শাহরুখ সম্পর্কে যা বলেছেন, সেটি দলের নেতৃত্বেরই মনের কথা। টুইটে তিনি শুধু শাহরুখ খানকে আক্রমণই করেননি, এটিও লিখেছিলেন ভারত যখন রাষ্ট্রপুঞ্জে স্থায়ী সদস্যপদ পেতে চাইছে, সেই সময় ভারতে অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি হলে পাকিস্তানের মত দেশেরই হাত শক্ত হবে। শাহরুখের মন্তব্য সেই ষড়যন্ত্রকারীদের হাতই আরও শক্ত করবে। এবং আজ হাফিজ সঈদের সমর্থন সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘কিন্তু দলের সমস্যা হল, পরিমিত বোধ। প্রকাশ্যে কতটা পাল্টা আক্রমণ করা হবে, তার প্রভাব কী পড়বে, সেটি সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। একবার দলের নেতৃত্ব কোনও মন্তব্য করলে বাকি ছোট-মাঝারি নেতারা সেটিকে খোলা ছুট হিসেবে নেন। তখন আর আদিত্যনাথদের মতো নেতাদের আর কাবুতে রাখা সম্ভব হয় না।’’
বিজেপির কাছে এই মুহূর্তে সবথেকে বড় সমস্যা হল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এত বছর ধরে কংগ্রেস ও বামপন্থী চিন্তাভাবনায় বিদ্বদজন তৈরি হলেও বিজেপির ভাঁড়ারে তেমন সংখ্যা নেই। তা না হলে এই মুহূর্তে সব থেকে ভাল কৌশল হত, কংগ্রেস সমর্থিত বুদ্ধিজীবীদের মোকাবিলায় বিজেপিও সার বেধে তাদের সমর্থিত বুদ্ধিজীবীদের আসরে নামিয়ে দিত। খুঁজেপেতে বলিউডের অভিনেতা অনুপম খেরকে বিজেপি বোঝাতে পেরেছেন, যিনি আগামী ৭ নভেম্বর পুরস্কার ফেরত দেওয়া শিল্পীদের বিরুদ্ধে দিল্লিতে রাস্তায় নামতে রাজি হয়েছেন। পরিচালক মধুর ভাণ্ডারকর, অশোক পণ্ডিতদের নিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে পদযাত্রা করবেন। রাষ্ট্রপতিকে বলবেন, গণতন্ত্রে কোনও বিপদ আসেনি। শুধুমাত্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ হচ্ছে।
কিন্তু অনুপম খেররা এগিয়ে এলেও যে ভাবে কৈলাস বিজয়বর্গীয়দের থেকে মন্তব্য আসছে, তাতেও বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। সে কারণে আজ অনুপম খেরকেও বলতে হচ্ছে, ‘‘বিজেপির কিছু নেতার মুখে সত্যিই কুলুপ আঁটা দরকার। শাহরুখ সম্পর্কে এ ধরনের আজেবাজে কথা বলা বন্ধ করতে হবে। শাহরুখ জাতীয় আইকন এবং আমরা তাঁর জন্য গর্বিত।’’ এই কারণেই আজ কৈলাসকে নিজের টুইট প্রত্যাহারের ঘোষণা করতে হল। তিনি এই ঘোষণা করলেও নিজের টুইট কিন্তু মুছে দেননি। বরং সেটি দিব্য বহাল রেখেছেন। তার পরেই লিখেছেন, ‘‘যদি দেশে অসহিষ্ণুতা থাকত, তা হলে অমিতাভ (বচ্চন)-এর পর শাহরুখ সবথেকে জনপ্রিয় হতেন না। আমার টুইট কিছু মানুষ অন্য ব্যাখ্যা করেছেন। কাউকে দুঃখ দেওয়া আমার উদ্দেশ্য ছিল না।’’ কিন্তু কৈলাসের প্রত্যাবর্তনের পরেও যোগী আদিত্যনাথ শাহরুখের সঙ্গে হাফিজ সঈদের তুলনা টেনে আরও চড়া ভাষায় বলেছেন, ‘‘এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা শাহরুখ খানের সিনেমা না দেখলে তিনি এত জনপ্রিয় হতেন না। তাঁকে রাস্তায় ঘুরতে হত। যে লেখক-শিল্পীরা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এ ধরনের মন্তব্য করছেন, তাঁরা দেশদ্রোহী। সন্ত্রাসের ভাষা বলছেন। শাহরুখও সেই গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছেন।’’
বিজেপি নেতারা কবুল করছেন, কংগ্রেস যে ভাবে অসহিষ্ণুতার প্রচারকে উচ্চগ্রামে নিয়ে গিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচার করা দরকার। কিন্তু কতটা দরকার, সেই খেই অনেকে হারিয়ে ফেলেন। বিজেপি নেতারা ঘরোয়া স্তরে অস্বীকার করছেন না, বিহারের শেষ দফার ভোটে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা। ফলে সেখানে মেরুকরণের রাজনীতির ফায়দা বিজেপি ঘরে তুলতে চাইছে। আর সে কারণেই সেখানে প্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী সুকৌশলে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছেন। এক দিকে, কংগ্রেসের অসহিষ্ণুতার জবাব দেওয়া গিয়েছে। আবার শিখ দাঙ্গার প্রসঙ্গও উস্কে দেওয়া গিয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস বলছে, আসলে গোটাটাই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর প্রচ্ছন্ন মদতে। দলের নেতা আনন্দশর্মা আজ বলেন, ‘‘শাহরুখ খান জনপ্রিয় অভিনেতা ও ভারতীয় নাগরিক। তাঁর জাতীয়তাবাদ নিয়েই আজ প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। আর যাঁরাই বিজেপির সমালোচনা করছেন, তাঁরাই যেন তাঁদের শত্রু। জাতীয়তাবাদকে বিকৃত করে বিজেপি নিজেই এখন হিন্দুত্বের মুখপত্র হয়ে উঠেছে। অথচ হিন্দু সংস্কৃতি এই অসহিষ্ণুতার কথা বলে না। আজ শাহরুখ খান শুধু নয়, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও এ ধরনের মন্তব্য করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী চুপ কেন? তিনিই সব কিছুর পিছনে প্রচ্ছন্ন মদত দিয়ে আসছেন।’’
প্রকাশ জাভড়েকরের কথায়, ‘‘প্রতি দিন খবরের কাগজে বা সংবাদমাধ্যমে যা যা ঘটবে, সব বিষয়ে মন্তব্য করা প্রধানমন্ত্রীর কাজ নয়। তবে হ্যাঁ এ কথা ঠিক, দাদরির ঘটনার পর আমাদের প্রতিক্রিয়া দিতে দেরি হয়েছে। যখন বিজেপির কোনও লেনাদেনা ছিল না, বিজেপির মদতেও কোনও ঘটনা ঘটেনি, সেই সময় বিজেপির ঘাড়ে বিরোধীদের দোষ চাপানোর আগেই দলের কড়া ভাষায় নিন্দা করা উচিত ছিল। আমরাও এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিচ্ছি। তবে তাই বলে কৈলাস বিজয়বর্গীয় বা যোগী আদিত্যনাথ যে ধরনের মন্তব্য করেছেন, সেটি দলের অবস্থান নয়।’’ বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি ও মোদী সরকারের মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডুও একই সুরে মন্তব্য করেও বলেছেন, ‘‘কংগ্রেস যে ভাবে অপপ্রচার শুরু করেছে, তার তো জবাব দিতে হবে। ইতিমধ্যেই প্রতিবাদী লেখক-শিল্পীদের কাছে আবেদন করা হয়েছে, সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে। জাতীয়তাবাদের যে নতুন ভাবনার উত্থান হচ্ছে, তার প্রতিও বাকিদের সহিষ্ণু হওয়া উচিত। তবে কংগ্রেস যে অসহিষ্ণুতার পরিচয় এত বছর ধরে দিয়ে এসেছে, তাদের থেকে আমাদের পাঠ নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy