ভুজের ভূমিকম্প সামাল দিতে নরেন্দ্র মোদীকে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। আজ সেই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই নেপাল, উত্তর ও পূর্ব ভারতের ভূমিকম্পের মোকাবিলায় নামলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নিজের হাতে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রশাসনিক দায়িত্ব তুলে নিয়ে আজ এক দিকে নেপালে দ্রুত সাহায্য পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছেন তিনি। অন্য দিকে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলির পাশে দাঁড়িয়ে বার্তা দিতে চেয়েছেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় তিনি কোনও রাজনীতির ভেদাভেদ করছেন না।
আজ সকালে দিল্লির মেট্রোয় চেপে রাজধানীর দ্বারকায় একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রীর মেট্রো-সফর ঘিরেই দিল্লির রাজনৈতিক শিবিরে আলোচনা চলছিল। এর মধ্যেই ভূমিকম্প হতে টেলিফোন নিয়ে বসে পড়েন মোদী। প্রথমেই তিনি ফোন করেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালাকে। কৈরালা বিদেশে ছিলেন। তাঁকে না পেয়ে নেপালের প্রেসিডেন্ট রামবরণ যাদবকে ফোন করেন তিনি। জানান, ভারত দ্রুত সাহায্য পাঠাচ্ছে। পরে কৈরালার সঙ্গেও কথা হয় মোদীর। টুইটারে তিনি জানান, নেপালের পাশে আছে ভারত। দেশে ও বিদেশে ক্ষতিগ্রস্তদের সম্পর্কে দ্রুত খবর নিয়ে সাহায্য পৌছনোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি মেনে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিমানবাহিনীর সি১৩০জে হারকিউলিস বিমান ত্রাণসামগ্রী ও উদ্ধারকারী বাহিনী নিয়ে কাঠমান্ডু রওনা হয়ে যায়। পরে আরও তিনটি বিমান পাঠানো হয়েছে।
নেপালকে সাহায্যের বন্দোবস্ত করে একে একে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। ঘটনাচক্রে আজ মোদী সরকার তথা বিজেপির মোকাবিলায় জনতা পরিবারের রণকৌশল ঠিক করতে দিল্লিতে এসেছিলেন নীতীশ। তখনই তাঁর সঙ্গে কথা বলেন মোদী। তিনটি রাজ্যের মধ্যে বিহারেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও মৃত্যুর সংখ্যা সব চেয়ে বেশি। নীতীশকে মোদী জানিয়ে দেন, জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী (এনডিআরএফ)-এর পাঁচটি দল বিহারে পাঠানো হচ্ছে। এর পর মধ্যপ্রদেশ ও সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতে দায়িত্ব তুলে নেওয়ায় অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় ভূমিকম্পের মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার মাঠে নেমে পড়ে। নেপালের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ত্রাণ পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় বিদেশসচিব এস জয়শঙ্করকে। দেশের মধ্যে কোন রাজ্যে কতখানি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা জানতে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির মুখ্যসচিবদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেন স্বরাষ্ট্রসচিব এল সি গয়াল। বিভিন্ন মন্ত্রকের মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব হাতে তুলে নেন ক্যাবিনেট সচিব অজিত শেঠ। কেন্দ্র জানিয়েছে, ভূমিকম্পে এখনও পর্যন্ত ৫১ জন মারা গিয়েছেন। আহতের সংখ্যা ২৩৭ জন। নেপালে মৃতদের মধ্যে দু’জন ভারতীয় রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে এক জন ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীর মেয়ে। দূতাবাসের একটি বাড়ি ভেঙে পড়ায় মদন নামে ওই কর্মীর মেয়ে মারা যান। গুরুতর আহত হন মদনের স্ত্রী। কাঠমান্ডুর বীর হাসপাতালে আর এক ভারতীয়ের মৃত্যুর খবর মিলেছে।
২০০১ সালে ভুজে ভূমিকম্পের পরে ত্রাণ ও দুর্যোগ মোকাবিলায় গাফিলতির অভিযোগ উঠেছিল। সে সময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কেশুভাই পটেল। বাজপেয়ীর নির্দেশে কেশুভাইকে সরিয়ে মোদীকে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিজেপি নেতারা দাবি করেন, মোদীর অক্লান্ত পরিশ্রমেই ভূমিকম্পের পরেও ভুজকে নতুন করে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। যা দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। ভুজের হাতে-কলমে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই আজ প্রশাসনের সব ক’টি শাখাকে এক সঙ্গে মাঠে নামিয়ে দেন মোদী। বিহার থেকে বিজেপি তথা এনডিএ-র মন্ত্রী ও সাংসদদের নিজেদের এলাকায় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দেন। তার পর বিকেল তিনটেয় অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিংহ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি নৃপেন্দ্র মিশ্র, অন্যান্য শীর্ষ আমলা, আবহাওয়া দফতর ও এনডিআরএফ-এর কর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। ক্যাবিনেট সচিবের নেতৃত্বে জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা কমিটিরও বৈঠক হয়। বিদেশ প্রতিমন্ত্রী ভি কে সিংহকেও দুর্যোগ মোকাবিলার বিষয়টি দেখভাল করতে বলেন মোদী।
প্রধানমন্ত্রীর তৎপরতায় সন্ধের আগেই ৩ টন ত্রাণসামগ্রী, এনডিআরএফ-এর ৮০ জন জওয়ান ও উদ্ধারের আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে বিমানবাহিনীর হারকিউলিস বিমান কাঠমান্ডু পৌঁছে যায়। পরে দিল্লির কাছে হিন্ডন বিমানঘাঁটি থেকে আরও দু’টি বিশাল আকৃতির সি১৭ গ্লোবমাস্টার বিমান পাঠানো হয়। নেপালের অনুরোধ মেনে একটি গ্লোবমাস্টার বিমানে রয়েছে মোবাইল হাসপাতাল। সঙ্গে ছিল চিকিৎসক ও কর্মীদের নিয়ে তৈরি ‘‘র্যাপিড অ্যাকশন এরো মোবাইল টিম’’। বিদেশসচিব জয়শঙ্কর বলেন, ‘‘হারকিউলিস বিমানটিকে কাঠমান্ডুর আশপাশে রাস্তাঘাট ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি কতখানি হয়েছে, তা জরিপ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’’ আগামিকাল কাঠমান্ডুতে ৫টি ও পোখরায় ৫টি হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হবে। উদ্ধার করার পাশাপাশি খাবার, পানীয় জল, তাঁবু, কম্বল, ওষুধপত্র পৌঁছে দেওয়ার কাজ করবে কপ্টারগুলি। ভাটিন্ডা থেকে একটি বিমানে ইঞ্জিনিয়ারদের একটি বিশেষ দল পাঠানো হয়েছে।
নেপালে যে সব ভারতীয় পর্যটক আটকে পড়েছেন, তাঁদের উদ্ধার করারও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। জয়শঙ্কর জানান, আটকে পড়া পর্যটকদের আত্মীয়েরা তাঁদের নাম, ফোন নম্বর বিদেশ মন্ত্রকে জানালে প্রশাসনের তরফে সাহায্য করা হবে। আটকে পড়া ১৫৫ জন ভারতীয়কে নিয়ে ইতিমধ্যেই দিল্লিতে ফিরেছে বায়ুসেনার বিমান। কাঠমান্ডুতে ভারতীয় দূতাবাসের মুখপাত্র অভয় কুমার জানান, দূতাবাসে কন্ট্রোল রুম ও দু’টি হেল্পলাইন খোলা হয়েছে (+৯৭৭-৯৮৫১১০৭০২১, +৯৭৭-৯৮৫১১৩৫১৪১)। আটকে পড়া বাঙালি পর্যটকদের উদ্ধারের বিষয়টি দিল্লিতে রাজ্যের রেসিডেন্ট কমিশনার দেখছেন বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভূমিকম্পের পরে সাধারণ বিমান চলাচলের জন্য কাঠমান্ডু বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বিমান মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, বিমানবন্দর খোলা হলেই আটকে পড়া ভারতীয়দের নিয়ে আসতে এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিগোর বিমান কাঠমান্ডু পৌঁছে যাবে। সড়ক পথেও তাঁদের ফেরানোর চেষ্টা চলছে। সে দেশের একটা বড় অংশে ইন্টারনেট কাজ করছে না। টেলিভিশন সম্প্রচার বন্ধ। বহু জায়গায় বিদ্যুৎ নেই।
সন্ধ্যায় দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা নেপালকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছি। এই দুর্যোগের মোকাবিলা করার শক্তি ঈশ্বর ওঁদের দিন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy