Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শুরু ভাল, শেষ নয়, অর্থনীতি: স্রেফ পাশ রাজনীতি: দশে সাত

সুযোগ ছিল। চেষ্টাও যে একেবারে করেননি তা নয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না! বাজেট মানে যে সরকারের জমা ও খরচের হিসেব, আর কিছু নয়, এই সরল সত্যটাকে দেখিয়ে দিতে পারতেন অরুণ জেটলি। আলাদা রেল বাজেট পেশের নব্বই বছর পার করা ঐতিহ্যটাকে বিদায় করে দিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকার এক পা এগিয়েওছিল।

সংসদে বাজেট পেশের আগে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। বুধবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।

সংসদে বাজেট পেশের আগে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। বুধবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৪:১৪
Share: Save:

সুযোগ ছিল। চেষ্টাও যে একেবারে করেননি তা নয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না!

বাজেট মানে যে সরকারের জমা ও খরচের হিসেব, আর কিছু নয়, এই সরল সত্যটাকে দেখিয়ে দিতে পারতেন অরুণ জেটলি। আলাদা রেল বাজেট পেশের নব্বই বছর পার করা ঐতিহ্যটাকে বিদায় করে দিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকার এক পা এগিয়েওছিল। সেই পথ ধরেই শুক্লা পঞ্চমীতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বাজেটের অঙ্ক থেকে রাজনীতিকে বিদায় জানাতে পারতেন। কিন্তু এ বারের বাজেটে হাজার হাজার প্রকল্প, দান-খয়রাতির মেলা, গরিবের জন্যে অশ্রুপাত অন্য বারের তুলনায় কম হলেও শেষ পর্যন্ত সে-সব পুরোপুরি বাদ দেওয়া গেল না। মোটের ওপর একটা চেনা ছকেই দু’ঘণ্টার ভাষণ শোনালেন জেটলি— গাঁধী-বন্দনা এবং শায়েরি সমেত।

সব বাজেট বক্তৃতারই দু’টো দিক থাকে। একটা অর্থনীতির, অন্যটা রাজনীতির। আজ অর্থনীতির পরীক্ষায় বড়জোর মেরেকেটে পাশ করবেন জেটলি। কিন্তু রাজনীতির পরীক্ষায় তিনি দশে দশ না হোক, সাত-সাড়ে সাত দাবি করতে পারেন অনায়াসেই।

মোদীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে সব থেকে বেশি ধাক্কা খেয়েছিলেন গরিব, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে ছোট ব্যবসায়ীরা। নগদের জোগান কমে যাওয়ায় কেউ রুটিরুজি হারিয়েছিলেন। কারও ব্যবসা মার খেয়েছিল। ক্ষোভ গিয়ে পড়েছিল মোদী সরকার তথা বিজেপির উপরেই। অথচ আর দশ দিন পরেই উত্তরপ্রদেশের ভোট শুরু হচ্ছে। আসলে যা ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের সেমিফাইনাল। একই সঙ্গে রয়েছে পঞ্জাব-সহ আরও চারটি রাজ্যের ভোট। বিজেপি নেতাদের আশঙ্কা, নোট বাতিলের ফলে চোট লাগবে ভোটের বাক্সে।

সেই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা মেনেই আজ বাজেটে গরিব, মধ্যবিত্ত বা ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ‘উপহার’ হাজির করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। রাগ-অভিমান কমিয়ে, ফের মন জয়ের চেষ্টায় কম আয়ের মানুষদের করের বোঝা কমিয়েছেন। আড়াই থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে করের হার ১০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছেন। দরাজ হাতে কর কমিয়েছেন ছোট ও মাঝারি শিল্পের ওপর, যে ক্ষেত্রগুলির ব্যবসায়ীরাই বিজেপি-র সব থেকে বড় ভোটব্যাঙ্ক। বাজেটের ছত্রে ছত্রে উঠে এসেছে গ্রাম ও গরিবের কথা। একশো দিনের কাজের প্রকল্পে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দাবি করে জেটলি বলেছেন, গ্রাম ও দারিদ্র দূরীকরণে বেশি খরচ করবেন ভেবেই তিনি বাজেট তৈরি করতে বসেছেন। বাজেটে চাষিদের ১০ লক্ষ কোটি টাকা ঋণের সংস্থান করা হয়েছে। এক কোটি মানুষকে দারিদ্রের কবল থেকে তুলে আনার স্বপ্ন দেখিয়েছেন জেটলি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২০১৯-এর মধ্যে গৃহহীনদের জন্য ১ কোটি বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে। আবার মোদী সরকার যে ‘স্যুট-বুটের সরকার’ নয়, যেন সেটা প্রমাণ করতেই ধনীদের করের বোঝা কিছুটা বাড়িয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাই একে ‘উত্তম বাজেট’ আখ্যা দিয়েছেন। সর্বজনীন ন্যূনতম আয় নিয়ে জেটলি বাজেটে কিছু বলেননি ঠিকই। কিন্তু বাজেটের পরে বলেছেন, সরকার এ বিষয়ে ইতিবাচক। অন্য কিছু দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পের পরিবর্ত হিসেবে সকলের জন্য আয়ের কথা ভাবা যেতে পারে।

মুশকিল হল, গ্রাম-গরিবের মন জয় করতে গিয়ে শিল্প ও বিনিয়োগের পথের কাঁটা দূর করতে ভুলে গিয়েছেন জেটলি। মোদী জমানার তিন বছরেও দেশের শিল্পপতিরা লগ্নি করতে শুরু করেননি। মূলধনী খাতে ব্যয় ক্রমশ কমছে। তার উপর নোট বাতিলের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য মার খেয়েছে। মোদী সরকার এত দিন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র ঢাক পিটিয়ে দেশে শিল্পায়নের কথা বলেছে। অথচ আজকের বাজেটে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ শব্দটিরই উল্লেখ নেই। কোন পথে নতুন বিনিয়োগ আনতে চাইছেন, তারও কোনও দিশা দেখাতে পারেননি জেটলি। এমনকী ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ বা অনাদায়ী ঋণের সমস্যা সমাধানের পথনির্দেশও নেই।

নতুন লগ্নি টানার জন্য বাজেটে কী রয়েছে, এই প্রশ্ন করা হলে জেটলি বলেন, ‘‘বাজেটে নানা রকম সংস্কারের পদক্ষেপ করা হয়েছে। বিশ্ব জুড়ে আর্থিক মন্দার ফলে যে সব ক্ষেত্র সঙ্কটে পড়েছিল, তাদের সমস্যা মেটাতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। লগ্নি টানার জন্যই এই সব পদক্ষেপ। কোনও একটি পদক্ষেপে বিনিয়োগ চাঙ্গা করা সম্ভব নয়।’’

প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে নতুন চাকরি তৈরি হবে কী করে! দু’দিন আগেই মনমোহন সিংহ-পি চিদম্বরম অভিযোগ করেছিলেন, যে পরিমাণ চাকরি দরকার, তাতে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আজ বাজেটের পরে এই প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণকে বলতে হয়েছে, একশো দিনের কাজের মতো গ্রামোন্নয়ন ও পরিকাঠামোয় বিপুল ব্যয় বরাদ্দ থেকেই রোজগারের সুযোগ তৈরি হবে। ছোট ও মাঝারি শিল্পে সব থেকে বেশি কর্মসংস্থান হয় বলেই, বছরে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যবসায় করের হার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে।

শিল্পমহল এই বাজেট থেকে বিরাট কিছু সংস্কারের আশা করেনি। নোট বাতিলের ধাক্কায় প্রলেপ দেওয়া হবে, কিছু কর ছাড় দেওয়া হবে, পরিকাঠামোয় ব্যয় বাড়বে, এমনটাই আশা ছিল। তারা তাই সরকারের নিন্দা করেনি। কিন্তু মনমোহন এ দিন বলেন, ‘‘অর্থমন্ত্রী বাজেটে অনেক কিছুই ছুঁয়ে গিয়েছেন। কিন্তু নোট বাতিলের ফলে অর্থনীতিতে ধাক্কা নিয়ে কিছুই বলেননি।’’
আজ জেটলি দাবি করেছেন, নোট বাতিলের ধাক্কা সাময়িক। আগামী অর্থ বছরে তার প্রভাব পড়বে না। মনমোহনের প্রশ্ন, ‘‘নোট বাতিলের ধাক্কা স্থায়ী হবে না, এ কথা উনি কী করে বিশ্বাস করলেন, তার কোনও ইঙ্গিত মিলল না।’’

দেশীয় লগ্নি না আসায় এখনও যে বিদেশি লগ্নিই ভরসা, তা-ও বাজেটেই স্পষ্ট। বিদেশি লগ্নির জন্য দরজা আরও খোলার আশ্বাস দিয়ে এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকা বিদেশি লগ্নি উন্নয়ন পর্ষদ (এফআইপিবি) তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। সীতারমণের দাবি, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র জন্য যে ক্ষেত্রগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার সবগুলিতেই বিদেশি লগ্নি আসছে।

দেশীয় লগ্নি আসছে না বলে জেটলির সামনে অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার একমাত্র উপায় ছিল সরকারি ব্যয় বাড়ানো। বিশেষ করে পরিকাঠামোয়। জেটলি বলেছেন, আগামী অর্থ বছরে পরিকাঠামোয় তিনি রেকর্ড অর্থ বরাদ্দ করেছেন। প্রায় ৩.৯৬ লক্ষ কোটি টাকা। এর সঙ্গে রেলে ১.৩ লক্ষ কোটি (যার মধ্যে বাজেট বরাদ্দ ৫৫ হাজার কোটি, বাকিটার বন্দোবস্ত করবে রেল) ও জাতীয় সড়কে ৬৪ হাজার কোটি টাকা ঢালছেন।

এ বছরই প্রথম পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে ব্যয়ের ভেদাভেদ তুলে দিয়ে মোট ব্যয়কে মূলধন ও রাজস্ব খাতে ভাগ করা হচ্ছে। কিন্তু পরিকাঠামোয় বিপুল টাকা ঢাললেও দেখা যাচ্ছে, মূলধন খায়ে ব্যয়ও চলতি বছরের থেকে আগামী বছর ০.১ শতাংশ কম হবে।

গ্রাম-গরিবের জন্য বিপুল খরচ করতে গিয়ে এ বার বাজেটে ঘাটতির রাশ আলগা করেছেন জেটলি। আগামী অর্থ বছরে ঘাটতি ৩ শতাংশে কমিয়ে আনার কথা ছিল। তার বদলে ৩.২ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছেন তিনি। যাতে হাতে বেশি টাকা থাকে। অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। কারণ আয়কর ছাড় দিতে গিয়ে আয় কমেছে। এই বছরই জিএসটি চালু হবে বলে পরোক্ষ করের হারেও বিশেষ রদবদল হয়নি। ফলে নতুন আয়ের রাস্তা তৈরি হয়নি। একমাত্র রেলের তিনটি সরকারি সংস্থা ও জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলির বিলগ্নিকরণ বাবদ ৭২,৫০০ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। সব থেকে বড় কথা, নোট বাতিলের ফলে কালো টাকার উপরে কর বসিয়ে সরকারের আয় বাড়ছে, এমন কোনও অঙ্কও চোখে পড়েনি।

জেটলি চাইলে অবশ্য ঘাটতি বাড়িয়ে ৩.৫ শতাংশে নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সেই ঝুঁকি তিনি নেননি। কারণ ঋণ-সুদের বোঝা বাড়ালে আন্তর্জাতিক মূল্যায়নকারী সংস্থাগুলি ভারতের অর্থনীতি সম্পর্কে আরও নেতিবাচক মনোভাব নেবে।

বাজেট নথি খুঁটিয়ে দেখলে তাই বোঝা যাচ্ছে, গ্রাম-গরিবের জন্য খরচ হচ্ছে বলে যতটা ঢাক পেটানো হয়েছে, সেই তুলনায় খরচ বাড়ছে না। একশো দিনের কাজে এ বছরের তুলনায় খরচ বাড়ছে মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা, মিড ডে মিল-এর মতো প্রকল্পেও খরচ প্রায় একই থাকছে।

সেটা হয়তো জমাখরচের হিসেবে ভালই। কিন্তু সে-কথাটা জোর গলায় বলতে পারলেন না নরেন্দ্র মোদীর অর্থমন্ত্রী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE