দিল্লিতে তখন নরসিংহ রাওয়ের জমানা। কংগ্রেস সরকারের আর্থিক নীতির প্রতিবাদে দেশজুড়ে আন্দোলন চলছে নিয়মিত ভাবে। বিরোধী আসনে বসে সে সবের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অটলবিহারী বাজপেয়ী।
এর মধ্যেই কাশ্মীর নিয়ে শুরু হল টানাপড়েন। চাপ একেবারে আন্তর্জাতিক স্তরে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে সরাসরি রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতকে কোণঠাসা করতে উদ্যোগী পাকিস্তান। ইসলামাবাদকে জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন প্রধানমন্ত্রী রাও। জেনেভায় রাষ্ট্রপুঞ্জের সভায় বেছে বেছে পাঠালেন তাঁর পছন্দের ভারতীয় প্রতিনিধিদল। সেই দলের নেতৃত্ব দিতে বিদেশনীতিতে বাজপেয়ীকেই বেছে নিলেন তিনি। বিরোধী দলের নেতা নেতৃত্ব দিলেন ভারতের। রাষ্ট্রপুঞ্জে তীক্ষ্ণ জবাব দিয়ে ভারতের সম্মান রক্ষা করেছিলেন নরসিংহ রাওয়ের দূত বিরোধী দলনেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী।
ভারতের মতো দেশে এটা একটা বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়, বিদেশনীতির প্রশ্নে অলিখিত নিয়ম। দেশে সংঘাত যতই থাক, বিদেশে ঐক্যের বার্তা দিতেন শাসক ও বিরোধী দলগুলি। কিন্তু সৌজন্যের সেই পর্বও আপাতত প্রশ্নের মুখে। নরেন্দ্র মোদীকে কংগ্রেস আজ হুঁশিয়ারি দিয়েছে, বিদেশে গিয়ে যদি তিনি আবার তাদের সমালোচনা করেন, পাল্টা জবাব দেবেন তাঁরা। তাদের অপদস্থ করতে প্রধানমন্ত্রী কখন কি বলে ফেলেন, তাই এ বার মোদী যে দেশেই যাবেন, পিছু পিছু তাদের মুখপাত্রদেরও সেখানে পাঠিয়ে দেবেন সনিয়া গাঁধী। ‘বাজে’ কথার একেবারে হাতে গরম ‘জবাব’ দিতে।
দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিদেশ পর্যন্ত তাড়া করার এমন হুমকি বেনজির। বিতর্কের সূত্রপাত বিদেশে মোদীর বক্তৃতাকে কেন্দ্র করে। কংগ্রেসের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী এ যাবৎ প্রতিটি বিদেশ সফরে অনাবাসী ভারতীয়দের সামনে ঘরোয়া রাজনীতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। ম্যাডিসন স্কোয়ারের বক্তৃতা থেকে শুরু। তার পর বিদেশ সফরে গেলেই হয় মোদী বিরোধীদের পরোক্ষে টিপ্পনি করেছেন, বা এই বার্তা দিতে চেয়েছেন স্বাধীন ভারতে কিছুই উন্নয়ন হয়নি! ক’দিন আগে বার্লিনে আর গত কাল টরোন্টোয় অনাবাসী ভারতীয়দের সম্মেলনে বক্তৃতা দেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর স্বচ্ছতা অভিযান প্রসঙ্গে টরোন্টোয় মোদী বলেন, ‘‘যাদের আবর্জনা ছড়িয়ে রেখে যাওয়ার কথা ছিল, তারা তা করে চলে গেছে। আমি পরিষ্কার করে যাব। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ নয়, আমাদের লক্ষ্য দক্ষ দেশ গড়ে তোলা।’’
প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে গেলে ঘরোয়া রাজনীতির প্রসঙ্গ বিশেষ না তোলা বা বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজের দেশের বিরোধীদের সমালোচনা না করাই দস্তুর। তাই আজ কংগ্রেসের জোরালো প্রতিক্রিয়া। বিস্মিত পর্যবেক্ষকরাও। তবে তাঁরা বলছেন, বিতর্ক থেকে বাদ যাননি মনমোহন সিংহও। বিজেপি পরমাণু চুক্তিতে আপত্তি করায় বিদেশের মাটিতে মুখ খুলে তাঁদের ‘অবাক পিছুটানের’ সমালোচনা করেছিলেন মনমোহন। তখন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গের অভিযোগ এনে সংসদের ভিতরে ও বাইরে তোলপাড় করেছিলেন অরুণ জেটলিরা।
কংগ্রেস নেতা আনন্দ শর্মা বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী মানসিক বিকারগ্রস্ত! তিনি যখন শিষ্টাচার ভাঙবেন বলেই ঠিক করেছেন, তখন তাঁকে তাঁর ভাষাতেই জবাব দিতে হবে।’’ তাঁদের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী ভারতের বদনাম করছেন। কখনও দেশকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলছেন, কখনও বলছেন, আর ভিক্ষা করতে হবে না।
মোদী গত কাল বলেছিলেন, ‘‘৪২ বছর পরে ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী কানাডা সফরে এলেন এবং তাঁকে এমন সাদর সংবর্ধনা দেওয়া হল। এটা ইতিবাচক ঘটনা!’’ প্রধানমন্ত্রীর সেই দাবি খারিজ করে শর্মা বলেন, ‘‘‘সব সময়েই ‘আমি’-র আবরণে মোদী! নিজেকে ঢেকে রেখেছেন! কানাডা যাওয়ার আগে ওনার পড়াশুনা করা উচিত ছিল। ২০১০-এ সে দেশে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হারপার তখনও সেই পদেই ছিলেন।’’ আনন্দ শর্মা জানান, কংগ্রেস মুখপাত্ররা এ বার থেকে অপপ্রচারের জবাব সে দেশের মাটিতে দাঁড়িয়েই দেবেন। কংগ্রেস নেতারা যদিও মানছেন, এ সবে দেশের সম্মান বাড়বে না। তবে তাঁদের মতে, এ জন্য মোদীকেই সংযত হতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy