Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মৃত মায়ের পাশেই ঘুমিয়ে ছেলে

নীল অয়েলক্লথ মোড়া সরু একটা খাট। তার উপরে জলের বোতল, একটা আপেল, আর একটা প্লাস্টিকে মোড়া কয়েক টুকরো আনারস। সেখানেই জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে একরত্তি ছেলেটা। আর পাশে শুয়ে তার হাড় জিরজিরে মা। মায়ের গায়ে গা ঠেকিয়ে ঘুমোচ্ছে ছেলে, অনেক ক্লান্তির পরে যেন পরম আরামের এক ঘুম।

হাসপাতালে নিথর সামিনার পাশে শোয়েব। হায়দরাবাদে।

হাসপাতালে নিথর সামিনার পাশে শোয়েব। হায়দরাবাদে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
হায়দরাবাদ শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৩:১৪
Share: Save:

নীল অয়েলক্লথ মোড়া সরু একটা খাট। তার উপরে জলের বোতল, একটা আপেল, আর একটা প্লাস্টিকে মোড়া কয়েক টুকরো আনারস। সেখানেই জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে একরত্তি ছেলেটা। আর পাশে শুয়ে তার হাড় জিরজিরে মা। মায়ের গায়ে গা ঠেকিয়ে ঘুমোচ্ছে ছেলে, অনেক ক্লান্তির পরে যেন পরম আরামের এক ঘুম।

কিন্তু মা যে মারা গিয়েছেন ঘণ্টা দু’য়েক আগে!

রবিবার রাতে হায়দরাবাদের ওসমানিয়া হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডের এই ছবি হতবাক করে দিয়েছিল ডাক্তার-নার্সদের। ছেলেটিকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বহু চেষ্টা করেন তাঁরা। কিন্তু তাকে একচুলও নড়ানো যায়নি।

কী হয়েছিল সে দিন?

রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ প্রবল শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সামিনা সুলতানা। সঙ্গে পাঁচ বছরের ছেলে, শোয়েব। সামিনাকে বাঁচানো যায়নি, রাত সাড়ে বারোটায় মারা যান তিনি।

পুরো সময়টা মায়ের পাশ থেকে এক বারের জন্যও সরেনি শোয়েব। ডাক্তাররা যখন হাল ছেড়ে দিলেন, তখনও মায়ের খাটের পাশে দাঁড়িয়ে। তারপর নার্স-ডাক্তাররা সরে যেতেই মায়ের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে। এ রকম ভাবেই ঘণ্টাদু’য়েক ঘুমিয়ে ছিল শোয়েব। তারপর সামিনার দেহ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মর্গে।

কোনও প্রাপ্তবয়স্ক সঙ্গে না থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খবর দেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে। তারা শোয়েবের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে, কয়েক দিন ধরেই ভুগছিলেন সামিনা। যে লোকটির সঙ্গে থাকতেন, সে রবিবার সন্ধেবেলা মা-ছেলেকে হাসপাতালের বাইরে বসিয়ে রেখে চলে যায়। মাকে ধরে ধরে হাসপাতালের ভিতরে নিয়ে এসেছিল ছোট্ট শোয়েব-ই। কিন্তু তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী ইমরান মহম্মদ জানিয়েছেন, শোয়েবের কাছে তার মায়ের আধার কার্ড ছিল। সেই ঠিকা়নাতেই পুলিশ গিয়ে সামিনের ছোট ভাই মুশতাক পটেলের খোঁজ পায়। সোমবার সন্ধেবেলা এসে সামিনার দেহ নিয়ে যান মুশতাক। নিয়ে যান মা-হারা শোয়েবকেও। তখনও সে জানে, বেশি শরীর খারাপ হয়েছে বলে মাকে হাসপাতালের অন্য কোথাও সরানো হয়েছে। হায়দরাবাদ থেকে ফোনে মুশতাক বললেন, ‘‘একদম চুপ করে গিয়েছে ছেলেটা। কত কথা বলত, হুটোপাটি করত। এখন শুধু এক জায়গায় বসে আছে। কোনও কথা বলছে না, কাঁদছেও না।’’

মুশতাকদের আদত বাড়ি তেলঙ্গানার জহিরাবাদ থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে, ছোট্ট গ্রাম তুরমামিদিতে। পেশায় গাড়িচালক মুশতাক এখন থাকেন হায়দরাবাদের ফলকনুমায়। সামিনার সঙ্গে যার বিয়ে হয়েছিল, সেই আয়ুব বছর তিনেক আগে ছেলে-বউকে ছেড়ে চলে যায়। সামিনা ছেলেকে নিয়ে ওঠেন ছোট ভাইয়ের সংসারেই। ‘‘দিদি জোগাড়ের কাজ করত। মাস কয়েক আগে আমাদের ছেড়ে একটা লোকের সঙ্গে থাকতে শুরু করে। ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে যায়,’’ বললেন মুশতাক।

আর এখন? মুশতাকের গলায় কান্না, ‘‘আমার ছেলেমেয়ের সঙ্গেই মানুষ করব ওকে। ওর মাকে তো আর ফিরিয়ে আনতে পারব না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE