Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
General Election Results 2019

ব্যুমেরাং হল ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’? মোদীর বিকল্প হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে ব্যর্থ রাহুল

সপ্তদশ লোকসভা ভোটের ইভিএম খুলতেই দিকে দিকে বিজেপির জয়ধ্বনি। গত বারের চেয়েও আরও শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে সরকার গড়ার পথে এনডিএ জোট।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৯ ১৭:১৫
Share: Save:

১৫ লাখ চাকরির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ ছিল। ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগান ছিল। নোটবন্দি, জিএসটি থেকে বিজয় মাল্য, নীরব মোদী ইস্যুতে মোদী বিরোধী হাওয়া তুলতে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। ‘ন্যায়’ প্রকল্পের ঘোষণা হয়েছিল। ময়দানে নেমেছিলেন প্রিয়ঙ্কা গাঁধী। কিন্তু কোনও কিছুই কাজে এল না। নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেন না রাহুল গাঁধী। ভরাডুবি কংগ্রেসের। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের প্রশ্ন, তবে কি ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগান ব্যুমেরাং হয়ে ফিরল কংগ্রেসের হাতে?

সপ্তদশ লোকসভা ভোটের ইভিএম খুলতেই দিকে দিকে বিজেপির জয়ধ্বনি। গত বারের চেয়েও আরও শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে সরকার গড়ার পথে এনডিএ জোট। উল্টো দিকে কংগ্রেসের হাত ক্রমেই খালি হতে শুরু করেছিল। সেই প্রবণতা জারি রেখেই দেওয়াল লিখন স্পষ্ট হল, আরও এক বার মোদীতেই আস্থা রাখলেন দেশবাসী। আসন সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও কংগ্রেসের ঝুলিতে বলার মতো তেমন কিছুই প্রায় রইল না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাই মনে করছেন, মোদীর পরিবর্ত হিসেবে রাহুলকে দেশবাসী গ্রহণ করেননি।

গুজরাত দাঙ্গা পরবর্তী ২০০৭ সালে গুজরাতে বিধানসভা ভোট। সে রাজ্যে ভোট প্রচারে গিয়ে সোনিয়া গাঁধী মোদীকে বলেছিলেন, ‘মউত কা সওদাগর’। তা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। কিন্তু ভোট শেষে দেখা যায় বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে বিজেপি। সেই স্লোগান কার্যত ব্যুমেরাং হয়েছিল কংগ্রেসের কাছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাহুলের ক্ষেত্রেও কার্যত সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ বলে মোদীর বিরুদ্ধে যে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে চেয়েছেন রাহুল, তা ভাল ভাবে নেননি ভোটাররা। ফল হাতেনাতে পেয়ে গিয়েছে কংগ্রেস।

আরও পডু়ন: তৃণমূলের দুর্গ বাংলায় রকেট গতির উত্থান বিজেপির

কেন? প্রথমত, দিশাহীনতা। ভোটের আগে পর্যন্ত রাহুলের নেতৃত্বে কংগ্রেস স্পষ্ট লক্ষ্য স্থির করতে পারেনি। তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি), তৃণমূল কংগ্রেস, বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি), সমাজবাদী পার্টি (এসপি) নেতৃত্ব যখন বিজেপি বিরোধী মঞ্চ গড়ে একজোট হওয়ার চেষ্টা করেছেন, তখন কংগ্রেস তাদের সঙ্গে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো অবস্থান বজায় রেখেছে। কলকাতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহ্বানে ইউনাইটেড ইন্ডিয়া র‌্যালিতে প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন, অথচ বাংলায় জোট হয়নি। দিল্লিতে কেজরিওয়ালের সঙ্গে আসন সমঝোতা করেননি। উত্তরপ্রদেশে এসপি-বিএসপি জোটে সামিল না হয়ে আলাদা করে লড়েছেন। টিডিপি সুপ্রিমো চন্দ্রবাবুর সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠক করছেন, অথচ অন্ধ্রপ্রদেশে আলাদা লড়াই করেছেন। জোট বলতে শুধু ইউপিএ-র শরিকদের সঙ্গে তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, বিহারের মতো কয়েকটি রাজ্যে আসন সমঝোতা হয়েছে। তা ছাড়া, ভোটের পর এই জোটে সামিল হবেন কি না, নিজেরা সরকার গড়ার মতো অবস্থায় গেলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সে সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাননি সাধারণ মানুষ। বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি কংগ্রেসের এই দোদুল্যমান অবস্থান।

আরও পডু়ন: দেশ জুড়ে ফের গেরুয়া ঝড়! মোদীর শাসনেই ভারত, বিরোধী শিবির অন্ধকারেই

কয়েক মাস আগেই হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্য, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থানে বিজেপিকে হারিয়ে প্রায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে কংগ্রেস। কিন্তু সেই সব রাজ্যেও লোকসভায় শোচনীয় ফল কংগ্রেসের। কেন? রাজনৈতিক শিবিরের মতে, বিধানসভা ভোট এবং লোকসভা ভোট হয় আলাদা সমীকরণে। আমজনতার চাওয়া-পাওয়া থেকে নেতাদের প্রতিশ্রুতি, সবই আলাদা হয়। এই তিন রাজ্যের ভোটাররা সেই পরিণত মস্তিষ্কের সাক্ষ্যই রেখেছেন লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটে আলাদা আলাদা রায় দিয়ে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই তিন রাজ্যে কংগ্রেসের জয় এসেছিল আঞ্চলিক রাজনৈতিক সমীকরণ মেনে এবং দীর্ঘ দিনের বিজেপি শাসনে মানুষের বীতশ্রদ্ধ হওয়ার প্রতিফলন। রাহুল ফ্যাক্টর সেখানে কাজ করেছে খুব সামান্যই।

দ্বিতীয় কারণ হিসেবে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, কংগ্রেসের ঋণাত্মক প্রচার। ক্ষমতায় এলে কী করবেন, সেটার থেকেও রাহুল গাঁধীর প্রচারে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মোদী বিরোধিতা। ‘ন্যায়’ প্রকল্পে গরিব কৃষকদের বছরে ৭২ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তা ছাড়া সে ভাবে কোনও সদর্থক বার্তা ছিল না রাহুলের প্রচারে। অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো ক্ষেত্রে উন্নয়ন করতে কংগ্রেসের রোড ম্যাপ কারও কাছেই স্পষ্ট হয়নি। বরং মোদী জমানায় কী কী দুর্নীতি হয়েছে, কী ভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংসের চেষ্টা হয়েছে, নোটবন্দি-জিএসটিতে কী ক্ষতি হয়েছে, সে সবের কোনও দিশা ছিল না রাহুল তথা কংগ্রেসের প্রচারে। শুধু গোঁয়ার্তুমির মতো মোদী সরকারকে হঠাতে হবে, এটাই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু তাঁকে সরিয়ে বিকল্প কে আসবেন এবং তাঁরা দেশবাসীকে কী দেবেন, তার কোনও রূপরেখা তৈরি হয়নি। ফলে মানুষের কাছে আস্থা অর্জন করতে পারেননি রাহুল।

উল্টো দিক থেকে দেখলে, এই সব জায়গাতেই এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ, শৌচালয়, রান্নার গ্যাসের মতো সরকারি প্রকল্পের সাফল্য তুলে ধরে উন্নয়নের খতিয়ান এবং ক্ষমতায় এলে আরও উন্নয়নের স্বপ্ন ফেরি করেছেন মোদী। তার সঙ্গে জুড়েছেন উগ্র জাতীয়তাবাদ আর দেশাত্মবোধের হাওয়া। মোক্ষম সময়ে হাতে পেয়ে গিয়েছেন বালাকোটে বায়ুসেনার অভিযান, অভিনন্দন বর্তমানের ডগ ফাইটের মতো ইস্যু। অথচ এই দেশাত্মবোধের হাওয়ার বিরুদ্ধে জবাব দেওয়ার মতো জুতসই কোনও ব্যাখ্যা বা জবাব দিতে পারেনি রাহুলের নেতৃত্বে কংগ্রেস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE