Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

পটেল-সংরক্ষণের দাবিতে আগুন গুজরাত, হত ৮

বাইশ বছরের একটি সাদামাঠা ছেলে। অথচ পটেলদের সংরক্ষণের দাবিতে সেই হার্দিক পটেলের আন্দোলনে এখন অগ্নিগর্ভ প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্য গুজরাত। অশান্তি ছড়িয়েছে এতটাই যে, প্রধানমন্ত্রীকে শান্তির বার্তা দিতে হয়েছে। তাতেও আপাতত হাল ফেরার লক্ষণ নেই। উল্টে রাজ্য জুড়ে মঙ্গলবার থেকে একের পর এক ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আটে। এর মধ্যে পাঁচ জন প্রাণ হারিয়েছেন পুলিশের গুলিতে। পরিস্থিতি সামলাতে সেনা এবং আধাসেনা নামাতে হয়েছে। বন্‌ধ আর কার্ফুতে অচল হয়েছে আমদাবাদ-সহ বহু শহরের জনজীবন।

বিক্ষোভের আগুনে পুড়ে খাক গাড়ি। বুধবার আমদাবাদে।

বিক্ষোভের আগুনে পুড়ে খাক গাড়ি। বুধবার আমদাবাদে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৪২
Share: Save:

বাইশ বছরের একটি সাদামাঠা ছেলে। অথচ পটেলদের সংরক্ষণের দাবিতে সেই হার্দিক পটেলের আন্দোলনে এখন অগ্নিগর্ভ প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্য গুজরাত। অশান্তি ছড়িয়েছে এতটাই যে, প্রধানমন্ত্রীকে শান্তির বার্তা দিতে হয়েছে। তাতেও আপাতত হাল ফেরার লক্ষণ নেই। উল্টে রাজ্য জুড়ে মঙ্গলবার থেকে একের পর এক ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আটে। এর মধ্যে পাঁচ জন প্রাণ হারিয়েছেন পুলিশের গুলিতে। পরিস্থিতি সামলাতে সেনা এবং আধাসেনা নামাতে হয়েছে। বন্‌ধ আর কার্ফুতে অচল হয়েছে আমদাবাদ-সহ বহু শহরের জনজীবন।

হার্দিক কিন্তু তাতে দমে যাওয়ার ছেলে নন। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, সংরক্ষণ নিয়ে তাঁদের দাবি না-মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

২০০২ সালে গোধরা পরবর্তী দাঙ্গার পরে এত বড় গোলমাল আর হয়নি গুজরাতে। বরং রাজ্যকে লগ্নিকারীদের জন্য সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার ফসলও ফলতে শুরু করেছে গত কয়েক বছরে। শিল্পপতিদের আগমন বেড়েছে। এর মধ্যে হঠাৎ এমন অরাজকতায় সব দিক থেকে তটস্থ রাজ্য প্রশাসন। কিন্তু মঙ্গলবার রাত থেকে শুরু হওয়া প্রবল বিক্ষোভ সামলাতে তাদের কোনও চেষ্টাই কাজে দেয়নি এখনও। বরং পরিস্থিতির বদল না হওয়ায় আগামিকাল, বৃহস্পতিবারও স্কুল-কলেজ ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গোলমালের শুরু মঙ্গলবার থেকে। সরকারি চাকরি আর শিক্ষা ক্ষেত্রে গুজরাতের পটেল সম্প্রদায়কে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি)-র মর্যাদা দিয়ে সংরক্ষণের আওতায় আনা হোক— এই দাবি নিয়ে গত কাল আমদাবাদের জিএমডিসি ময়দানে জড়ো হয়েছিলেন প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন হার্দিক। আমদাবাদের বাসিন্দা, বিকম পাশ হার্দিক এমনিতে অত্যন্ত সাধারণ ছেলে। পরিবারের জল সরবরাহের ব্যবসা রয়েছে। রয়েছে কৃষি জমিও। বাড়ির লোকেরা চেয়েছিলেন, হার্দিক ব্যবসায় যোগ দিন। তা না করে তিনি ২০১১ সালে সর্দার পটেল গোষ্ঠী তৈরি করেন এবং সংরক্ষণ নিয়ে আন্দোলনে নামেন। গত কয়েক মাসে এই আন্দোলন তীব্রতা পেয়েছে। ‘পাটীদার অনামত আন্দোলন সমিতি’ গড়ে রাজ্য জুড়ে এর মধ্যে শতাধিক সমাবেশ করে ফেলেছেন হার্দিক। তাঁর বক্তব্য, গুজরাতের বর্তমান সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় পতিদাররা পিছিয়ে পড়ছেন। কারণ, পটেলদের সংরক্ষণ নেই বলে ভাল নম্বর থাকা সত্ত্বেও বড় কলেজে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান না তাঁরা।

এই আন্দোলনেই কাল জনসভা থেকে অনশনে বসেন হার্দিক। তার পরই পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। গোলমাল এড়াতেই এই গ্রেফতারি, জানিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু তাতে ফল হয় বিপরীত। পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগ তুলে রাত থেকে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় হিংসা ছড়াতে শুরু করে। পরিস্থিতির চাপে শেষমেশ রাতেই হার্দিককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ।

কিন্তু তত ক্ষণে হিংসা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। বিক্ষোভের নামে সরকারি সম্পত্তি তছনছ, সুরাতে শতাধিক সরকারি বাসে আগুন— চলতে থাকে আন্দোলনের নামে গুন্ডামি। একই সঙ্গে গ্রেফতারির প্রতিবাদে রাজ্যে বুধবার বন্‌ধের ডাক দেওয়া হয়। পরিস্থিতি সামলাতে বেশ কয়েকটি শহরে আজ সকাল থেকে কার্ফু জারির সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। আমদাবাদ তো বটেই পাটান, রাজকোট, মেহসানা, উনঝা, বিসনগর, জামনগর, পালানপুরে আজ স্বাভাবিক জনজীবন ছিল স্তব্ধ। কাল রাত থেকে আজ সকাল পর্যন্ত আধাসেনার ছোড়া গুলি ও পুলিশের মারধরে মৃত্যু হয়েছে ছ’জনের। এক জনের মৃত্যু হয়েছে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে। গোলমালে গুরুতর জখম এক পুলিশকর্মীর মৃত্যু হয়আজ রাতে। এরই মধ্যে নিরাপত্তার খাতিরে রাজ্যের বেশির ভাগ অংশে কেব্‌ল টিভি, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রেখেছে রাজ্য প্রশাসন।

আন্দোলনের হোতা হার্দিক নিজে অবশ্য হিংসা ছড়ানোর অভিযোগ মানতে চাননি। উল্টে তাঁর বক্তব্য, ‘‘পুলিশই নির্বিচারে অত্যাচার চালাচ্ছে আমাদের সমর্থকদের উপর।’’

যে বল্লভভাই পটেলের মূর্তি তৈরি মোদীর স্বপ্নের প্রকল্প, সেই পটেল সম্প্রদায়ের লোকজনের আন্দোলনের আঁচ স্তিমিত করতে আজ মাঠে নামতে হয় খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। আজ একটি টিভি চ্যানেলে গুজরাতি ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘মনে রাখতে হবে এ ভাবে হিংসা ছড়িয়ে কিন্তু কোনও দিনই কিছু লাভ করা যায় না।’’ বলেছেন, ‘‘গুজরাত গাঁধী আর সর্দার পটেলের রাজ্য। শান্তিই এখানে একমাত্র মন্ত্র।’’ রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেন পটেলের সঙ্গে আজ সকালেই কথা হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের। কেন্দ্র জানিয়েছে, আপাতত পাঁচ কোম্পানি সেনা পাঠানো হয়েছে গুজরাতে। সঙ্গে তৈরি রাখা হয়েছে রাজ্যের বিশেষ বাহিনীকেও।

প্রশ্ন হল, গুজরাত জুড়ে এই গোলমালের পিছনে কি কোনও রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে? হার্দিকের বাবা বিজেপির সমর্থক। তবে হার্দিকের দাবি, তাঁর সঙ্গে কোনও দলের যোগ নেই। অনেকে তাঁকে কেজরীবালের শিষ্য বলছেন। তাতেও তাঁর আপত্তি। কিন্তু গুজরাতের রাজনীতিতে গুঞ্জন, এর পিছনে রয়েছে প্রবীণ তোগাড়িয়ার মদত। গত দু’দিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি ঘুরতে শুরু করেছে। মোদী-বিরোধী বলে পরিচিত ভিএইচপি প্রধান প্রবীণ তোগাড়িয়ার পাশে দাঁড়িয়ে হার্দিক। কোমরে পিস্তল গোঁজা। বিজেপি শিবির সূত্রেই বলা হচ্ছে, গুজরাতে কংগ্রেসের এমন জোর নেই যাতে তারা এত বড় আন্দোলনে ইন্ধন দেবে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্য হলেও এবং দোর্দণ্ডপ্রতাপে দু’দশক সেখানে তিনি রাজ্যপাট সামলালেও গুজরাতে দলের মধ্যে তাঁর বিরোধীর সংখ্যা কম নয়। আর সেই তালিকায় প্রথম দিকে রয়েছে তোগাড়িয়ার নাম। মোদীর স্বপ্নের রাজ্যকে অশান্ত করতে তিনি হার্দিককে ঠিক কতটা সমর্থন করছেন, সেই প্রশ্ন দিল্লির রাজনীতিতেও ঘুরপাক খাচ্ছে। হার্দিক নিজেও কাল বলেছেন, ‘‘আমাদের দাবি মানা না হলে ২০১৭-র বিধানসভা ভোটে আর পদ্ম ফুটবে না গুজরাতে।’’ মোদীকে সরাসরি এমন চ্যালেঞ্জ ছোড়ার সাহস হার্দিক কী করে দেখাচ্ছেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। তোগাড়িয়া অবশ্য আজ এক বিবৃতিতে গুজরাতের মানুষকে শান্ত থাকার আর্জি জানিয়েছেন।

নিন্দুকেরা বলেন, আনন্দীবেনকে সামনে রেখে গুজরাতের রাজনীতি চালান মোদীই। বিহার ভোটের পর্ব সাঙ্গ হলে মোদী-ঘনিষ্ঠ অমিত শাহ গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন বলে খবর। এই অবস্থায় অমিতের গুজরাতে ফেরা আটকাতেই কি এমন চাল চালছেন তোগাড়িয়া? উগ্র হিন্দুত্ববাদ নিয়ে মোদী-তোগাড়িয়ার দ্বন্দ্ব কম হয়নি আগে। পটেল-সংরক্ষণ সমরে তাই তাঁর নামই ফিরছে রাজনীতির কারবারিদের মুখে মুখে।

মোদীর সঙ্গে সমানে পাঞ্জা কষে চলা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়েননি। হার্দিকের আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন তিনি। যদিও নীতীশের দলেরই অন্যতম নেতা শরদ যাদব সংরক্ষণের বিরুদ্ধে মত জানিয়েছেন। তবে একে ভারসাম্যের রাজনীতি বলেই দেখছেন অনেকে।

এই অবস্থায় আজ মোক্ষম চাল দিয়েছেন মোদী। মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে তিনি গুজরাত আর উত্তরাখণ্ডের চারটি জাতিকে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই তালিকায় কিন্তু পটেল সম্প্রদায়ের নাম নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters Gujarat bandh Army violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE