Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Supreme Court

বৈদ্যুতিন সাক্ষ্যপ্রমাণের শংসাপত্র নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়

ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য আদালতে কী ভাবে পেশ করতে হবে, তা নিয়ে ভারতীয় সাক্ষ্য আইনে নতুন ধারা ৬৫বি নিয়ে আসা হয়।

ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য কী ভাবে পেশ করতে হবে, তাই নিয়ে ভারতীয় সাক্ষ্য আইনে ২০০০ সালে নতুন ধারা ৬৫বি যুক্ত হয়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য কী ভাবে পেশ করতে হবে, তাই নিয়ে ভারতীয় সাক্ষ্য আইনে ২০০০ সালে নতুন ধারা ৬৫বি যুক্ত হয়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বিভাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২০ ১৯:৪১
Share: Save:

ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ইন্টারনেট ব্যবহারকারী দেশ। আজকের যুগে বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমায়, ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য ছাড়া কোনও কিছু প্রমাণ করা খুব কঠিন। প্রতিটি মানুষের প্রতিটি ইলেকট্রনিক কার্যকলাপের প্রতিলিপি এখন রেকর্ডভুক্ত হয়ে থাকে। যেমন ধরুন একজন মহিলা হয়ত স্বামীর ফেসবুক প্রোফাইলে, বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে, নানান মহিলার সঙ্গে স্বামীর অন্তরঙ্গ ছবি পেলেন। তিনি তার স্বামীর বিরুদ্ধে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করতে চাইলে সেই ছবিগুলো খুব প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য হিসেবে কাজ করতে পারে। এই অবস্থায় ওই পোস্টগুলোর স্ক্রিনশট আদালতকে দিতে হবে, যাতে আদালত তার সত্যাসত্য বিচারের পর রায় দিতে পারেন।

আজকে বিভিন্ন রকমের মামলায় ইলেকট্রনিক সাক্ষ্যের ব্যাপক প্রয়োগ হচ্ছে এবং আগামী দিনে আরও অনেক অনেক বেশি প্রয়োগ হবে। ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য যদি ঠিক মতো আদালতে প্রমাণ করা যায়, তা হলে এর থেকে ভাল সাক্ষ্য আর কিছুই হতে পারে না। অনেক মামলায় এ রকম অভিযোগ ওঠে যে, সাক্ষীকে কেনাবেচা করা হয়েছে বা সাক্ষী মিথ্যে কথা বলেছে বা বলছে। এ রকম হামেশাই আমরা শুনতে পাই। কিন্তু ইলেকট্রনিক সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে সাক্ষ্যকে প্রভাবিত করা কঠিন কাজ, কেননা সে ক্ষেত্রে প্রভাবিত করার কারণ এবং প্রভাবিত হবার পদ্ধতি ধরা পড়ে যায়।

আবার অনেক ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য ছাড়া অন্য কোনও সাক্ষ্য থাকেই না। যেমন কোনও কোনও খুনের ঘটনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ। সে ক্ষেত্রে সিসিটিভি ফুটেজ খুনের রহস্য সমাধান করতে এবং প্রকৃত বিচার পর্বের জন্য একান্ত আবশ্যক।

প্রতিনিয়ত বেড়ে যাওয়া সাইবার অপরাধের তদন্ত বা বিচার প্রক্রিয়ায় ইলেকট্রনিক তথ্য অন্যতম এবং বহু ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে কাজ দেয়।

অর্থাত্‌ ইলেকট্রনিক এভিডেন্স সত্যিকে প্রমাণ করার পক্ষে বা ন্যায় বিচারের স্বার্থে আজকের ব্যবস্থায় খুবই কার্যকরী এবং জরুরি হয়ে উঠেছে। ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য আদালতের কাছে কী ভাবে পেশ করতে হবে, তাই নিয়ে ভারতীয় সাক্ষ্য আইনে ২০০০ সালে নতুন ধারা ৬৫বি নিয়ে আসা হয় এবং বলা হয় যে ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের ধারা ৬৫বি-এর সার্টিফিকেটের মাধ্যমে দাখিল করতে হবে।

যদি ডিভাইস এমন হয় যে তাকে আদালতে নিয়ে আসা সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক সাক্ষ্যের সঙ্গে ৬৫বি ধারা অনুযায়ী সার্টিফিকেট দেওয়া এখন বাধ্যতামূলক।

আরও পড়ুন: পাটুলিতে করোনা-আক্রান্ত স্বামীকে জুতোপেটা প্রতিবেশীদের, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হেনস্থা

সংসদে জঙ্গি হামলার মামলায় ইলেকট্রনিক সাক্ষ্যের সঙ্গে প্রত্যয়ন সার্টিফিকেট দিতেই হবে এ কথা আদালত বলেনি। কিন্তু ২০১৪ সালে বশির মামলায় (Anvar P.V. v. P.K. Basheer&Ors) ইলেকট্রনিক সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে এই সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক বলে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট| এর পরে ৬৫বি সার্টিফিকেট নিয়ে অনেক রকমের বাদানুবাদের পর ২০১৮ সালে শফি মহম্মদ (Shafhi Mohammad v. State of Himachal Pradesh) মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে— ৬৫বি সার্টিফিকেট ইলেকট্রনিক সাক্ষ্যের সঙ্গে সব জায়গায় বাধ্যতামূলক নয়| এই রায় সুপ্রিম কোর্টের পূর্ববর্তী বশির মামলায় রায়ের সম্পূর্ণ পরিপন্থী| এই অবস্থায় দুটো মামলার রায়কে আরও বিচার করে, প্রকৃত ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের উচ্চতর বেঞ্চে বিষয়টা পাঠানো হয়| দীর্ঘ অপেক্ষার পর, এ মাসে অর্জুন পণ্ডিত রাও মামলায় (Arjun Pandit rao Khotkar Versus Kailash Kushanrao Gorantyal And Ors) সুপ্রিম কোর্ট আগের সমস্ত বাদানুবাদের মীমাংসা করে এবং এক ঐতিহাসিক রায় দেয়|

আরও পড়ুন: ঘরের সদস্যদের থেকেই করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি, বলছে সমীক্ষা

সংক্ষেপে এই রায় সম্বন্ধে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বলা যায়:

• শফি মহম্মদ মামলার রায় নস্যাৎ হয়ে যায় এবং ৬৫বি সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে বশির মামলার রায় বহাল থাকে|

• কোনও বাদী বা বিবাদী যে ডিভাইসে (যেমন মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদিতে) প্রথম বার ইলেকট্রনিক স্বাক্ষর সঞ্চয় করে রেখেছেন, সাক্ষ্য দানের সময় তিনি যদি ওই ডিভাইস (যাতে ওই ইলেকট্রনিক তথ্য প্রথমবার রাখা হয়েছে) নিয়ে উপস্থিত হন, তা হলে ওই ব্যক্তিকে তার ডিভাইসে থাকা ইলেকট্রনিক তথ্য প্রমাণ করার জন্য ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের ৬৫বি ধারার কোনও সার্টিফিকেট দিতে হবে না|

• কিন্তু যদি ডিভাইস এমন হয় যে তাকে আদালতে নিয়ে আসা বা বহন করে আনা সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক্স সাক্ষ্যের সঙ্গে ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের ৬৫বি ধারা অনুযায়ী সার্টিফিকেট দেওয়া বাধ্যতামূলক|

• ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার বা মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডারের উপর এই মামলায় নির্দেশ দেওয়া হয় যে— যখন কোনও ফৌজদারি মামলায় তারা সিডিআর বা অন্য কোনও তথ্য প্রদান করে, সে ক্ষেত্রে এই কোম্পানিদের সংশ্লিষ্ট ইলেকট্রনিক তথ্য সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। মামলার বিচার চলাকালীন সাক্ষ্যের সময় যদি প্রয়োজন হয়, তা হলে তাদের ওই সিডিআর বা অন্য কোনও তথ্য প্রদান করতে হবে আদালতে|

• এ ছাড়া প্রধান বিচারপতির নির্দেশে ইলেকট্রনিক সাক্ষ্যের যে ড্রাফ্ট রুলের কথা বলা হয়েছে সেটা নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করে কোর্টের বিচারকার্যে ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য কী ভাবে নিয়ে আসা হবে তার উপরে প্রকৃত নিয়মাবলী প্রণয়নের কথা এই মামলার রায়ে বলা হয়েছে|

ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য পৃথিবী জুড়ে সমস্ত বিচার বিভাগের কাছে একটা নতুন ঘটনা এবং নতুন চ্যালেঞ্জ। তাই এই রায় বিভিন্ন দিক থেকে যুগান্তকারী এবং ঐতিহাসিক। আগামী দিনে আমাদের বিচার পদ্ধতি থেকে শুরু করে তদন্তকারী অফিসারদের কর্মপদ্ধতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এই রায়।

(শীর্ষ আদালতের সম্পূর্ণ রায় এই লিঙ্কে পাবেন: https://main.sci.gov.in/supremecourt/2017/39058/39058_2017_34_1501_22897_Judgement_14-Jul-2020.pdf)

লেখক সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE