উদ্ধারকার্যে নামছেন মৎস্যজীবীরা। ছবি: রয়টার্স
তিরুঅনন্তপুরমের ছবির মত পাহাড়ে ঘেরা এলাকায় কেরল সরকারের সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং। ঝকঝকে সেই বাড়ির মধ্যেই আরও ঝকঝকে কাঠপালিশ করা একটি ঘরে বসেন কেরল সরকারের রাজস্ব সচিব পি এইচ কুরিয়েন। গত পনেরো দিন এই ঘরটাই হয়ে উঠেছিল কেরল রাজ্যের ভরকেন্দ্র। কারণ রাজস্ব সচিবের পাশাপাশি বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরটিও ছিল তারই হাতে।
বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে যে ভাবে কাজ করেছেন পি এইচ কুরিয়েন, সেই কথা এখন ঘুরছে মুখে মুখে। তিনি না থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো, সে কথা স্বীকার করছেন সবাই। বিপর্যয় মোকাবিলায় তাঁর বানানো মডেল সারা দেশের কাছেই একটা উদাহরণ হয়ে দাঁড়ালো, এমন টাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি কাজে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে বরাবরই সওয়াল করে এসেছেন পি এইচ কুরিয়েন। আর বিপর্যয় মোকাবিলার দায়িত্ব নিয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তিকেই ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন তিনি। তাঁর মোবাইল আর কম্পিউটারই হয়ে উঠেছিল যুদ্ধক্ষেত্রের ওয়ার রুম। কোন জেলার কোন প্রান্তরে কতটা বৃষ্টি হয়েছে, কতজন কোথায় জলবন্দি হয়ে আছেন, কোন বাঁধ থেকে কত জল ছাড়া হচ্ছে, বৃষ্টির পূর্বাভাস কী, সমস্ত খবর নিঁখুত নিশানায় এসে হাজির হতো তাঁর ওয়ার রুমে।
ই-সৈনিকদের সেনাপতি পি এইচ কুরিয়েন। ছবি: সংগৃহীত
‘‘আমরা উদ্ধারকার্য শুরু করেছিলাম ৯ অগস্ট। ১০ তারিখে আমরা কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোর আবেদন করি। তার কয়েক দিন পরই উদ্ধারকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন মৎস্যজীবীরা। ওঁরা চলে আসার পর আমাদের কাজে অনেকটা সুবিধে হয়।’’ নিজেকে কোনও কৃতিত্বই দিতে রাজি নন কুরিয়েন।
আরও পড়ুন: বাজপেয়ীর চিতাভস্ম ভাসাতে গিয়ে নৌকা উল্টো জলে পড়লেন বিজেপি নেতারা!
কুরিয়েনের মাস্টারস্ট্রোক ছিল কেরালারেসকিউ ডট কম। বন্যার ফলে পরিস্থিতি খারাপ হতে চলেছে, এই ইঙ্গিত পাওয়ার পরই এই কয়েক জন আইএএস অফিসার, আবহবিদ ও প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে নিয়ে ঝটপট এই ওয়েবসাইটটি তৈরি করে ফেলেছিলেন তিনি। প্রথমে ছিল শুধু একটি লাইন- ‘রিকোয়েস্ট ফর হেল্প’। আস্তে আস্তে এই ওয়েবসাইটটিই হয়ে ওঠে উদ্ধারকার্যের ভরকেন্দ্র। কিন্তু কীভাবে?
বিশেষজ্ঞদের দলটি সারাক্ষণ নজর রেখেছিলেন ইন্টারনেটে। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ যেখান থেকেই সাহায্যের আবেদন আসছিল সেই জায়গার অবস্থান অর্থাৎ অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ তখনই গুগল লোকেশনের মাধ্যমে নথিবদ্ধ করে ফেলছিলেন তাঁরা। সঙ্গে সঙ্গে সেই তথ্য ভরে দেওয়া হচ্ছিল ওয়েবসাইটটিতে। যে উদ্ধারকারী দল সেই লোকেশনের কাছে আছেন, তাঁরা সেই খবর পেয়ে যাচ্ছিলেন সরাসরি ওয়েবসাইট থেকে। এলাকায় পৌঁছনোর পর আবার পরিস্থিতি বিচার করে সেই তথ্য ভরে দেওয়া হচ্ছিল ওয়েবসাইটটিতে। এইভাবেই ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে ওয়েবসাইটটি, যাকে ‘ক্রাউড সোর্সড’ বলছেন কুরিয়েন। কারণ সমস্ত তথ্যই আসলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পাওয়া।
আরও পড়ুন: বয়ফ্রেন্ড চাই? সেলেব হলে ঘণ্টায় ৩০০০ টাকা, আম আদমি ৩০০
এছাড়া চারটি বিভিন্ন দলের সঙ্গে ছ’টি সরকারি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও খুলেছিলেন কুরিয়েন। কোনও একদিন তাঁর কাছে এক লক্ষ হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ এসেছিল বলে জানাচ্ছেন তিনি। প্রতিটি মেসেজ দরকারমতো বিভিন্ন গ্রুপে ফরওয়ার্ড করাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ ছাড়া প্রতিটি ফোনকলও ট্র্যাক করা হচ্ছিল। কারণ আক্রান্ত মানুষের অবস্থান সহজে বুঝতে এর থেকে সহজ রাস্তা আর কিছু ছিল না তাঁদের কাছে।
পরিস্থিতি যখন সব থেকে খারাপ, তখন চার হাজার ত্রাণশিবির আর ১৪ লক্ষ ঘরছাড়া মানুষের সঙ্গে সমন্বয় রাখতে হত তাঁর দলকে। এই দলকে সাইবার আর্মিই বলছেন তিনি। কারণ দুর্গত মানুষ আর উদ্ধারকারী দলের মধ্যে যোগাযোগ রাখছিলেন এই কর্মীরাই। তবে এখন পরিস্থিতি একটু ভাল। তাই তাঁর সাইবার আর্মির সদস্যরা এখন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সরাসরি উদ্ধারকার্যে।
সব শেষে অবশ্য মৎস্যজীবীদেরই হিরো বলছেন তিনি। সরকারি হিসেব মতন যত মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে, তার ৬০ শতাংশই মৎস্যজীবীরা উদ্ধার করেছেন। তবে কুরিয়েন যাই বলুন, যে মডেলে তিনি উদ্ধারকার্য চালালেন তা-ও নজির হয়ে থাকল সারা দেশেই।
(কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাত থেকে মণিপুর - দেশের সব রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে আমাদের দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy