বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়েও ধনী এবং গরিবের মধ্যে তফাতটা চোখে পড়ার মতন। ছবি: এএফপি।
কিছু দিন আগেই বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে নাম উঠে এসেছে ভারতের। এই তকমা ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকা অনুসারে। ফ্রান্সকে টেক্কা দিয়ে এই স্থানে উঠে এসেছে আমাদের দেশ।
নোট বাতিল এবং জিএসটি সত্বেও অর্থনীতির দিক দিয়ে ভারতের এই উত্থান নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানান কথা তোলা হচ্ছে। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া মানে বেশ স্পেশ্যাল ব্যাপার। সামনে শুধু ব্রিটেন, জার্মানি, জাপান, চিন এবং আমেরিকা।
ভাল ব্যাপার কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এই যে ফ্রান্সকে টপকে গেলাম, তাতে হলটা কী। অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে এই অস্বস্তিকর প্রশ্নটা করতে হচ্ছে যে, তাতে আপনার-আমার কী হল? বড় অর্থনীতির গর্বে বুক ফোলানোর আগে, এক বার ভাবুন তো, আপনার কি আয় বাড়ল, সুযোগ-সুবিধা বেশি পেলেন, না ভবিষ্যৎ উদ্ভাসিত হল... একটু ভেবে দেখা যাক।
আরও পড়ুন
উন্মত্ত জনতার হিংস্রতা রুখতে কড়া আইন আনুক সংসদ: সুপ্রিম কোর্ট
২০১৭-র শেষ পর্যন্ত ভারতের জিডিপি ছিল ২.৫৯ ট্রিলিয়ন (২ লক্ষ ৫৯ হাজার কোটি) ডলার। আর ফ্রান্সের জিডিপি ২.৫৮ ট্রিলিয়ন (২ লক্ষ ৫৮ হাজার কোটি) ডলার। কিন্তু জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা মোট জাতীয় উত্পাদন) একটা সংখ্যা। ব্যাস, তার থেকে বেশি কিছু নয়। অন্য সংখ্যাগুলোকেও বিচারে আনতে হবে। যেমন, ভারতের জনসংখ্যা ১৩০ কোটি আর ফ্রান্সের জনসংখ্যা ৬ কোটি ৭০ লক্ষ। অর্থাত্ ভারতের জনসংখ্যা ফ্রান্সের প্রায় ১৯ গুণ। ১৯ জনের মোট আয় ১ জনের আয়কে অবশেষে টপকে যাওয়ার মধ্যে কিঞ্চিত স্বস্তি থাকতে পারে, কিন্তু লাফালাফি করার কিছু আছে কি?
অর্থনীতি বড় হোক বা ছোট, দিনের শেষে মানুষের পকেটে কত টাকা এল সেটাই বাস্তবের মাপকাঠি। ছবি: রয়টার্স।
অর্থনীতি বড় হোক বা ছোট, দিনের শেষে মানুষের পকেটে কত টাকা এল সেটাই বাস্তবের মাপকাঠি। তথ্য বলছে— মাথা পিছু আয়ের ক্ষেত্রে আমরা ফ্রান্সের থেকে অনেকটা পিছিয়ে। হ্যাঁ, বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়েও। ভারত অর্থনীতির আকার হিসাবে ফ্রান্সকে টপকেছে। কিন্তু ভারতের মাথা পিছু আয় য়েখানে ৭,০০০ মার্কিন ডলার, ফ্রান্সের মাথা পিছু আয় সেখানে ৪৩,০০০ ডলারেরও বেশি।
এর মানে, গড়ে একজন ভারতীয় এক ফরাসির তুলনায় অনেক দরিদ্র, যদিও অর্থনীতির আকার বিবেচনা করলে ভারত বড়। এই বৈপরীত্য ভাগ্যের পরিহাস। মাথা পিছু আয়ে (পিপিপি ফরমুলা অনুসারে) ভারত বিশ্বে এখন ১২৩ নম্বরে এবং ফ্রান্স আছে ২৫-এ। প্রায় ১০০ ধাপ উপরে। পকেটে টাকাই যদি বেশি না আসবে, তা হলে বৃহত্তর অর্থনীতি হয়ে দাম্ভিক হওয়া মানায় না। ফ্রান্সের মতো দেশকে সত্যিই ছুঁতে গেলে যতটা বড় হতে হবে আমাদের, তা কি সত্যিই দেখতে পারছি আমরা? বাস্তবটা হল, ধারেকাছেও না।
দারিদ্র্যের অভিশাপ
আরও একটা দিক ভেবে দেখার মতো। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়েও ধনী এবং গরিবের মধ্যে তফাতটা চোখে পড়ার মতন।
ভারতে ৭.১ কোটি মানুষ অতি দরিদ্র, অর্থাৎ দিনে ১৩০-১৪০ টাকা রোজগার নেই। ওই টাকা না পেলে বুঝতেই পারছেন খাওয়া, পরা, মাথার উপরে ছাদ কিছুই ঠিক করে পায় না এই নাগরিকবৃন্দ। অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যায় ভারত এখন বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে। সামনে আছে একমাত্র নাজেহাল অবস্থায় নাইজেরিয়া তার ৮.৭ কোটি মানুষ নিয়ে। যদি ভারতে ৫.২ শতাংশ মানুষ অতি দরিদ্র হন, ফ্রান্সে এই সংখ্যা ০.২%। কিন্তু ভারতের আছে ফ্রান্সের থেকে বড় অর্থনীতি।
অর্থাত্, যে মাপের অর্থনীতি আছে আমাদের, সেটুকুরও সুফল পৌঁছাতে পারা যায়নি সব থেকে গরিবদের ঘরে। সর্বস্বান্ত মানুষের সংখ্যা অনেক লক্ষ ছাড়িয়েছে অনেক দিন আগে। প্রত্যেক বছর হাজার হাজার চাষি আত্মহত্যা করেন। ৫ বছরের কম বয়সের ৪০ শতাংশ বাচ্চার যা উচ্চতা হওয়া উচিত, তার তুলনায় কম। এটা তাদের পুষ্টির একটা সূচক। কিন্তু দেখুন, রাস্তার ওপারে ধনীদের বাড়িতে খাবার নষ্ট হয়।
বিশাল অর্থনীতি হয়েও গরিব ক্রমশ গরীব হয়ে যাচ্ছে, এবং ধনী ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠছে।
২০১৭ সালে ভারতের সব থেকে ধনী ১ শতাংশ মানুষের কাছে ছিল দেশের ৫৮ শতাংশ সম্পদ। ২০১৭ বছরে ভারতের সব থেকে ধনবান ব্যক্তিদের প্রাচুর্য ২০ লক্ষ কোটি টাকা বাড়ে, যা ভারত সরকারের বার্ষিক বাজেটের আকার প্রায়! অক্সফ্যামের একটি গবেষণা বলছে যে, ভারতের বড় গার্মেন্টস কোম্পানির এক এক্সিকিউটিভ বছরে যা আয় করেন তা জোগাড় করতে গ্রামীণ ভারতে এক ন্যূনতম মজুরির শ্রমিকের লেগে যাবে ৯৪১ বছর! বুঝতেই পারছেন, ৯৪১ বছর কোনও মানুষের আয়ু হয় না, তাই এই বিশাল ফারাক অতিক্রম করা অসম্ভব।
আরও পড়ুন
মোদী ও শাহের আমলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি লোপ পেতে বসেছে
অনেকেই বলেন ভারতের গ্রামের থেকে শহরের অবস্থা ঢের ভাল। কিন্তু সতিই কি বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের শহরগুলি দারুণ? বেস্ট সিটিস র্যাঙ্কিং অন্য কথা বলছে। সেরা শহরগুলির প্রথম স্থানে আছে লন্ডন, দ্বিতীয় নিউ ইয়র্ক এবং তৃতীয় হল ফ্রান্সের প্যারিস। ১০০র মধ্যে একটাও ভারতীয় শহর নেই। কিন্তু বিশ্ব ম্যাপে ২০টি সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহরের মধ্যে মুম্বই আছে!
আমাদের দেশের অর্থনীতি যাতে সবার জন্যে কাজ করে সেটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের জন্যে অর্থনীতি, অর্থনীতির জন্যে মানুষ নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy