Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
National News

অমিতাভকে ভোটে দাঁড় করিও না, রাজীবকে বলেছিলেন ইন্দিরা

সাংবাদিক রশিদ কিদওয়াইয়ের লেখা বই ‘নেতা অভিনেতা: বলিউড স্টার পাওয়ার ইন ইন্ডিয়ান পলিটিক্স’ এই কথা জানিয়েছে।

অ্যালবাম থেকে: সঞ্জয় গাঁধী (বাঁ দিক থেকে), দারা সিংহের ভাই, রাজীব, ইন্দিরা গাঁধী, দারা সিংহ ও অমিতাভ বচ্চন

অ্যালবাম থেকে: সঞ্জয় গাঁধী (বাঁ দিক থেকে), দারা সিংহের ভাই, রাজীব, ইন্দিরা গাঁধী, দারা সিংহ ও অমিতাভ বচ্চন

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৪:১৮
Share: Save:

খুন হওয়ার কয়েক দিন আগে ছেলে রাজীবকে নিজের ঘরে ডেকে ইন্দিরা গাঁধী পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, ‘‘আর যাই কর, তেজি (বচ্চন)-র ছেলে অমিতাভকে কখনও ভোটের রাজনীতিতে এনো না।’’ এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক রাজীবের মাথায় তখন তাঁর ছেলেবেলার বন্ধু অমিতাভ বচ্চনকে লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের টিকিট দেওয়ার ভাবনাটা ঘুরপাক খাচ্ছে।

সাংবাদিক রশিদ কিদওয়াইয়ের লেখা বই ‘নেতা অভিনেতা: বলিউড স্টার পাওয়ার ইন ইন্ডিয়ান পলিটিক্স’ এই কথা জানিয়েছে।

ইন্দিরা তখন প্রধানমন্ত্রী। বড় ছেলেকে কথাটা একান্তে বলেননি ইন্দিরা। তাঁর ঘরে ওই সময় ছিলেন মাখনলাল ফোতেদার, অরুণ নেহরুর মতো নেতারা। ইন্দিরা-রাজীবের দূর সম্পর্কের আত্মীয় অরুণ তখন সাংসদ।

ইন্দিরার ঘনিষ্ঠ সহচর ফোতেদার জানিয়েছেন, সে দিন মায়ের মুখের ওপর কোনও কথা বলেননি রাজীব। কিন্তু মায়ের কথাটা যে পছন্দ হয়নি, তা রাজীবের মুখ-চোখ দেখেই বোঝা গিয়েছিল।

’৮৪-র লোকসভা ভোটে অমিতাভকে কংগ্রেসের টিকিট দেওয়া হয়েছিল। দাঁড় করানো হয়েছিল ‘প্রেস্টিজিয়াস’ ইলাহাবাদ কেন্দ্রে। ফোতেদার বলেছেন, ‘‘কেন ইন্দিরাজী বারণ করেছিলেন, তা আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু রাজীবজী জেদ ধরায় আমি আর কিছু বলিনি।’’

ফোতেদারের দাবি, সে দিন ছেলেকে আরও একটি উপদেশ দিয়েছিলেন মা ইন্দিরা। বলেছিলেন, ‘‘গ্বালিওরের প্রাক্তন মহারাজা মাধবরাও সিন্ধিয়াকে সব সময় হাতের কাছে রেখো।’’

অমিতাভের মা তেজি বচ্চন ছিলেন ইন্দিরার দীর্ঘ দিনের বান্ধবী। কিন্তু সেই সম্পর্কে পরে চিড় ধরেছিল। তার কারণ অবশ্য মুম্বইয়ের নামজাদা অভিনেত্রী, সুনীল দত্তের স্ত্রী নার্গিস। ইন্দিরা রাজ্যসভা সদস্য হিসেবে নার্গিসকেই মনোনীত করেছিলেন। আর তাতেই চটে যান তেজি বচ্চন। সেই খবরও বেরিয়েছিল ইন্দিরার কনিষ্ঠ পুত্রবধূ মানেকা গাঁধীর সম্পাদিত ম্যাগাজিন ‘সূর্য’-এ। তার পর ইন্দিরা বলেছিলেন, ‘‘ঠিকই করেছি। অন্য কারও তুলনায় নার্গিসই এই মর্যাদা পাওয়ার জন্য বেশি যোগ্য।’’ তেজি-ইন্দিরার মধ্যে দূরত্ব বাড়ার সেটাই শুরু।

কিন্তু তার অনেক আগে দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের সূত্রে অমিতাভ আর রাজীবের মধ্যে যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, তাতে রাজীব খুন হওয়ার আগে পর্যন্ত তেমন চিড় ধরেনি।

আরও পড়ুন- আইএসআই-এর নির্দেশেই পুলিশ কর্তাদের খুন! প্রমাণ পেয়েই বাতিল বৈঠক, বলছে দিল্লি​

কিদওয়াইয়ের লেখা বইটি জানাচ্ছে, সেটা সাত দশক আগেকার কথা। ১৯৬৮। রাজীব তখনও বিয়ে করেননি সনিয়া মাইনো (সনিয়ার ইতালিয় পদবি)-কে। ওই সময় সনিয়া ভারতে আসছিলেন। সেটা জানুয়ারি। খুব শীত পড়েছিল দিল্লিতে। ঘন কুয়াশায় ভোর হয়েছে, বোঝা যাচ্ছিল না। সাতসকালে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে সনিয়াকে ‘রিসিভ’ করতে গিয়েছিলেন অমিতাভ। শুধু অমিতাভই নন, তাঁর ভাই অজিতাভের সঙ্গেও তখন থেকেই খুব ভাব জমে যায় সনিয়ার। তার পর রাজীব-সনিয়ার বিয়ে হল। জন্ম হল রাহুল, প্রিয়ঙ্কার। তাঁরা বড় হতে থাকলেন। তখনও অমিতাভ, অজিতাভকে আত্মীয় বলেই মনে করতেন রাজীবের ছেলে, মেয়ে। অমিতভাকে ‘মামু’ বলে ডাকতেন রাহুল, প্রিয়ঙ্কা।

শুধুই যে রাজীবের বন্ধু ছিলেন অমিতাভ, তা নয়। জরুরি অবস্থার সময় অমিতাভকে প্রায় সব সময়ই দেখা যেত সঞ্জয়ের পাশে, পিছনে। অনেকে বলতেন, ‘সঞ্জয়ের ছায়া’! সেই ১৯ মাসে রেডিও, দুরদর্শন কিশোর কুমারের কণ্ঠরোধ করেছিল। অমিতাভ মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। প্রাণ, দেব আনন্দের মতো বলিউডের অভিনেতারা জরুরি অবস্থার সমালোচনা করায় তাঁদের কটাক্ষ করেছিলেন অমিতাভ। আর জিনাত আমনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ‘রসালো’ খবর যাতে না ছাপা হয় কোনও পত্রপত্রিকায়, তার জন্য জারি করা হয়েছিল সেন্সরশিপ।

সঞ্জয় গেলেন, রাজনীতিতে এলেন রাজীব। আর তখনই আরও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলেন অমিতাভ। দিল্লির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে ’৮২-র এশিয়ান গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘সিগনেচার ভয়েস’টি ছিল অমিতাভেরই। অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন রাজীব। মঞ্চে প্রধান সঞ্চালকের ভূমিকায় দেখা গেল অমিতাভকে। আর দর্শকাসনে একেবারে সামনের সারিতে বসে থাকতে দেখা গেল রাজীবকে।

অ্যালবাম থেকে: রাজীব গাঁধী ও অমিতাভ বচ্চন। ১৯৮৪

রাজীব চেয়েছিলেন বলে ’৮৪-র লোকসভা ভোটে ইলাহাবাদে কংগ্রেসের টিকিট পেলেন অমিতাভ। জিতলেন। সাংসদ হলেন। তার পর ’৮৫ থেকে ’৮৭, এই দু’বছরের মধ্যে অমিতাভের ওপর ‘বিরক্ত’ হয়ে পড়েছিলেন রাজীব, এমনটাই দাবি ফোতেদারের, তিন বছর আগে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীতে।

ফোতেদারের কথায়, ‘‘আমার কাছে রিপোর্ট আসছিল, এমপি হওয়ার পর থেকেই উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাজে বড় বেশি নাক গলাচ্ছিলেন অমিতাভ। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের আমলারা কে কোথায় বদলি হবেন, কোন আমলার চাকরি বা প্রমোশন হবে আর কার হবে না, সেই সব ব্যাপারে অমিতাভ ছড়ি ঘোরাচ্ছিলেন। উত্তরপ্রদেশে দলের প্রবীণ নেতারা এই সব নিয়ে আমার কাছে নালিশ ঠুকতেন। আমি তখন রাজীবজীর রাজনৈতিক সচিব। ইলাহাবাদ পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবীদের জায়গা। আর সেখানে তাঁর আসনের যাবতীয় কাজকর্ম অমিতাভ এমন এক জনকে দিয়ে করাতেন, যাঁকে কেউই গুরুত্ব দেন না।’’

ফোতেদার জানিয়েছেন, এখানেই শেষ নয়। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও মহারাষ্ট্রের মতো অন্য রাজ্যে দলের কোনও শাখা সংগঠনে কে কোথায় বসবেন, সে ব্যাপারেও নির্দেশ দিতে শুরু করেছিলেন অমিতাভ। রাজীবের রাজনৈতিক সচিবের কথায়, ‘‘ওই সময় রাজস্থানে তাঁর পছন্দের এক জনকে দলের মহিলা শাখার চেয়ারপার্সন করার জন্য চিঠি লিখে নির্দেশ দিয়েছিলেন অমিতাভ। সেই চিঠি আমি পড়েছিলাম। কিছুই বলিনি রাজীবজীকে। শুধু বলেছিলাম রাজস্থানের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী হরিদেব জোশীকে। উনি রাজি হলেন না। বললেন, কাকে ওই পদে বসাবেন, তা ওঁর ঠিক করা আছে।’’

আরও পড়ুন- ওলাঁদও চোর বললেন মোদীকে: রাহুল​

যে দিন রাজীব-অমিতাভের সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করল, সেই দিনটারও সাক্ষী ছিলেন ফোতেদারই।

অ্যালবাম থেকে: সেই সুখের দিনগুলিতে অমিতাভ, রাহুল, প্রিয়ঙ্কা ও সনিয়া

ফোতেদার জানিয়েছেন, এক দিন অমিতাভ দেখা করতে এলেন প্রধানমন্ত্রী (রাজীব)-র সঙ্গে। ওঁদের মধ্যে কথা হল বেশ কিছু ক্ষণ। বেলা তখন পৌনে তিনটে। ফোতেদার মধ্যাহ্নভোজে যাবেন বলে ভাবছেন। এমন সময় রাজীবজী ডাকলেন তাঁকে। ফোতেদার গিয়ে দেখলেন, সাত নম্বর রেসকোর্স রোডে (প্রধানমন্ত্রী বাসভবন) তখন অমিতাভকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটছেন রাজীব। ফোতেদার পৌঁছতেই তাঁকে আর অমিতাভকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন রাজীব। রাজীবের এক পাশে বসলেন অমিতাভ। অন্য পাশে ফোতেদার।

ফোতেদারের কথায়, ‘‘আসল চমকটা অপেক্ষা করছিল ওই খানেই। অমিতাভকে হঠাৎ রাজীবজী বললেন, ফোতেদার চাইছেন, তুমি পদত্যাগ কর। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। রাজীবজী যে এমন কথা বলবেন অমিতাভকে, আমি তার বিন্দুবিসর্গও জানতাম না। আগে আমার সঙ্গে কিছু আলোচনাও করেননি রাজীবজী। তা শুনে অমিতাভ বলেন, যদি ফোতেদার চান আমি ইস্তফা দিই, তা হলে দিয়ে দিচ্ছি। দাও কাগজপত্র দাও। কোথায় কী লিখে দিতে হবে বল।’’

ফোতোদার জানিয়েছেন, এর পরেই তিনি ডাকেন রাজীবের ব্যাক্তিগত সচিব ভিনসেন্ট জর্জকে। তাঁকে একটা রাইটিং প্যাড আর সাংসদ অমিতাভের লেটারহেড প্যাড আনতে বলেন।

ফোতেদার বলেছেন, ‘‘আমি অমিতাভকে বললাম, নিজের হাতে লিখুন লোকসভার স্পিকারকে। আপনি ইস্তফা দিতে চান। অমিতাভ জানতে চাইলেন, এইটুকু লিখে দিলেই হবে? তার পর সেই চিঠি পাঠানো হল স্পিকারকে। আর তা গ্রহণও হয়ে গেল।’’

ছবি- সংগৃহীত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE