জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করতে ‘বন্দে মাতরম্’ কি এখনও প্রাসঙ্গিক? প্রতীকী ছবি।
তামিলনাড়ুর স্কুল, কলেজ, সরকারি-বেসরকারি অফিস থেকে কলকারখানা— সর্বত্র ‘বন্দে মাতরম্’ গাওয়া বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা করেছে মাদ্রাজ হাইকোর্ট। সরকারি, বেসরকারি সব স্কুলে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হবে সপ্তাহে অন্তত দু’দিন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে মাসে অন্তত এক দিন। এই নির্দেশের পর যথারীতি বিতর্ক শুরু হয়েছে দেশ জুড়েই। ‘বন্দে মাতরম্’ গাওয়া বাধ্যতামুলক করা হলেই কি সকলের মনে দেশপ্রেম জেগে উঠবে? সেই সঙ্গে আবারও প্রশ্ন উঠছে, ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি সত্যিই কি আমাদের বহুভাষী, বহু ধর্মের দেশের জাতীয়তাবোধকে প্রতিনিধিত্ব করে?
একটি চাকরি সংক্রান্ত মামলায় বুধবার এই রায় দেয় মাদ্রাজ হাইকোর্ট। সে মামলার মূল বিচার্য বিষয় ছিল, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি কোন ভাষায় লিখেছিলেন! সংস্কৃতে? নাকি বাংলায়? উত্তরে তামিলনাড়ুর অ্যাডভোকেট জেনারেল জানিয়েছেন, ‘বন্দে মাতরম্’ (ন্যাশনাল সং) সংস্কৃত ভাষার হলেও তা আসলে বাংলা হরফে লেখা হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতরম্’-এর ২৬টি লাইনের মধ্যে প্রথম দু’টি স্তবকের ১২টি লাইন জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেয় ভারত সরকার। বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর রচনা নিয়ে দীর্ঘ দিন গবেষণা করছেন অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, “পুরো গানটাই আসলে সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে। তবে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত অংশটুকু সংস্কৃত ভাষায় লেখা। এবং তা বাংলা হরফে রয়েছে।” অর্থাত্ তামিলনাড়ুর অ্যাডভোকেট জেনারেলের কথাতেই সায় দিয়েছেন অমিত্রসূদনবাবু।
আরও পড়ুন
কোত্থাও যাওয়া নয়, অবসরে লেখার কাজ শুরু করছেন প্রণব
অমিত্রসূদনবাবুর মতো একই মত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর মতে, দেশের সাধারণ মানুষের জন্যই সহজ ভাবে লেখা হয়েছে এই গান। শীর্ষেন্দুবাবু বলেন, “জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম’-এর মতোই সংস্কৃত ভাষায় কাব্যিক আঙ্গিকে লেখা ‘বন্দে মাতরম্’। সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারেন এমন ভাবেই গানটি লিখেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমের পুরো গানেই সংস্কৃতের সঙ্গে মিশে রয়েছে বাংলা শব্দ।” একই মত দিলেন গবেষক তথা বর্ধমানের মানকর কলেজের স্তরের শিক্ষক বিজয় সাউ। ‘বন্দে মাতরম্’ গান নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। তিনি বলেন, “দুর্গাবন্দনার জন্য প্রথমে ওই গানটি লেখেন বঙ্কিমচন্দ্র। পরে ওই গানটিকে আরও বড় আকারে লিখে তা ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করেন।”
ভাষার বিষয়টি স্পষ্ট হলেও আরও একটি প্রশ্ন উঁকি দেয়। জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করতে ‘বন্দে মাতরম্’ কি এখনও প্রাসঙ্গিক? এ নিয়ে অবশ্য একমত নন অনেকেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণারত বিপ্লব দত্ত এ নিয়ে বেশ বিপরীত মন্তব্যই করলেন। তাঁর মতে, “জাতীয় সঙ্গীতে কেবলমাত্র হিন্দু ভারতের কথাই বলা হয়েছে। এতে দেশের বহু ভাষাভাষী বা বহু ধর্মের মানুষের স্বর শোনা যায় না। ফলে ‘বন্দে মাতরম্’ এই বহুভাষিক দেশের বহুত্ববাদকে সমর্থন করে না।” তাঁর মতে, জাতীয় সঙ্গীত এমন হওয়া উচিত যা জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষকেও ঐক্যবদ্ধ করবে। পাশাপাশি জাতীয় অগ্রগতির কথাও শোনাবে।” তবে এ নিয়ে শীর্ষেন্দুবাবুর মত ভিন্ন। তাঁর মতে, “নানা সংস্কৃতির দেশ হলেও আমাদের, বিশেষত বাঙালিদের মধ্যে দেশপ্রেম দানা বাঁধছে না। বরং বিদেশি সংস্কৃতির দিকেই তাঁদের ঝোঁক বেশি।” ফলে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে জাতীয় সঙ্গীতের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। এটি বাধ্যতামূলক করায় সমর্থনও রয়েছে তাঁর। তিনি বলেন, “এমনটা নয় যে, জাতীয় সঙ্গীত গাইলেই সকলের মনে দেশাত্ববোধ জাগ্রত হবে। তবে এই প্রচেষ্টা দুর্বল হলেও তা প্রশংসনীয়।” যদিও ভাষাবিদ পবিত্র সরকার এতে সমর্থন জানাননি। তিনি বলেন, “এটি আদৌ প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ জাতীয় সঙ্গীত গাইলেই দেশাত্ববোধ জেগে উঠবে, এটা অত্যন্ত ভুল ধারণা। বরং এটি সাধারণ মানুষের কাছে বেশ উৎপীড়নের বলেই মনে হয়।” তাঁর মতে, ‘বন্দে মাতরম্’-কে বাধ্যতামূলক করার জন্য যে উদ্যোগ চলছে, তার পিছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধি থাকলেও থাকতে পারে। একই মত পোষণ করেন বিজয়বাবুও। তিনি বলেন, “জাতীয় স্তরের একটি রাজনাতিক দল সুবিধা নেওয়ার জন্যই এই প্রচেষ্টা শুরু করেছে বলে মনে হয়।”
আরও পড়ুন
দেশে দু’বছরে ৪১ শতাংশ বেড়েছে হেট ক্রাইম, বলছে কেন্দ্রের রিপোর্ট
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘বন্দে মাতরম্’ বাধ্যতামূলক করার উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, তা নিয়ে আমজনতার আগ্রহ যে অনেক কমে এসেছে তা মানলেন প্রায় প্রত্যেকেই। একই সঙ্গে সমাজের অধিকাংশের মত, জোর করে কারও উপরে জাতীয় সঙ্গীত চাপিয়ে দেওয়াটাও উচিত নয়।
কয়েক মাস আগে দেশের সব সিনেমা হলে ‘জনগণমন’ (ন্যাশনাল অ্যান্থেম বা জাতীয় স্তোত্র) বাজানো বাধ্যতামুলক করার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই রায় এবং তার পরবর্তী কিছু ঘটনাবলী নিয়েও বিতর্ক ছড়ায় দেশের নানা প্রান্তে। এ বার মাদ্রাজ হাইকোর্টের ‘বন্দে মাতরম্’ রায় নিয়েও এক সুরে বাজছে না দেশের কণ্ঠ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy