Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ক্যাম্পাসে খালিদরা, বাইরে পুলিশ

পাঁচিল ঘেরা ক্যাম্পাসের ভিতরে বন্ধুদের সঙ্গে বসে থাকা এক দলের গলায় চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস, ‘‘পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করুক। আমরা তৈরি আছি।’’ যা শুনে পাঁচিলের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশবাহিনীর প্রধান বলছেন, ‘‘ওরাই আত্মসমর্পণ করুক। তার পর প্রমাণ করুক যে, ওরা নির্দোষ!’’

প্রতিবাদ চলছেই। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদের জমায়েত। সোমবার। ছবি: পিটিআই।

প্রতিবাদ চলছেই। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদের জমায়েত। সোমবার। ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৫৬
Share: Save:

পাঁচিল ঘেরা ক্যাম্পাসের ভিতরে বন্ধুদের সঙ্গে বসে থাকা এক দলের গলায় চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস, ‘‘পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করুক। আমরা তৈরি আছি।’’

যা শুনে পাঁচিলের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশবাহিনীর প্রধান বলছেন, ‘‘ওরাই আত্মসমর্পণ করুক। তার পর প্রমাণ করুক যে, ওরা নির্দোষ!’’

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতি কানহাইয়া কুমারের জামিন সংক্রান্ত মামলাটি আগামিকাল দিল্লি হাইকোর্টে শুনানির জন্য উঠবে। তার আগে উমর খালিদ-সহ জেএনইউয়ের পাঁচ ছাত্রের গ্রেফতার না আত্মসমর্পণ, এই নিয়ে আজ দিনভর চলল টানাপড়েন। গত দশ দিন ধরে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ওই পাঁচ ছাত্রকে দিল্লি পুলিশ খুঁজছিল। রবিবার রাতে নাটকীয় ভাবে তাঁরা উদয় হন ক্যাম্পাসে। তবে পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকে তাঁদের গ্রেফতার করেনি। বাইরেই দাঁড়িয়ে থেকেছে। পুলিশের আনা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ উড়িয়ে রবিবার রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের জমায়েতে খালিদ বলেছিলেন, ‘‘আমার নাম উমর খালিদ। আমি জঙ্গি নই!’’ আজ বিদ্রুপের সুরে তিনি বলেন, ‘‘আমার সম্পর্কে গত ক’দিনে এমন অনেক কিছুই জেনেছি, যা আমি নিজেই জানতাম না!’’ পুলিশ সূত্রে বলা হয়েছিল, গত ক’দিনে খালিদের মোবাইল থেকে কাশ্মীর ও উপসাগরীয় দেশে আটশো ফোন গিয়েছে। খালিদ আগে পাকিস্তানও ঘুরে এসেছে। যা শুনে খালিদ বলছেন, ‘‘কাশ্মীর বা উপসাগরীয় দেশ— আমি কোথাও কোনও ফোনই করিনি! আর আমার তো পাসপোর্টই নেই! তা-ও কী ভাবে পাকিস্তানে গেলাম, বুঝতে পারছি না!’’ একই সঙ্গে বিজেপির ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-কে কটাক্ষ করে তাঁর মন্তব্য, ‘‘এই ক্যাম্পাসে ওরাই বানর সেনা!’’


উমর খালিদ। জেএনইউ ক্যাম্পাসে প্রেম সিংহের তোলা ছবি।

খালিদের সঙ্গেই অনির্বাণ ভট্টাচার্য, রাম নাগা, আশুতোষ যাদব ও অনন্ত প্রকাশ নারায়ণের বিরুদ্ধেও ‘লুকআউট’ নোটিস জারি করেছিল পুলিশ। সোমবার এঁরা সকলেই সারা দিন প্রশাসনিক ব্লকের সামনে সহপাঠীদের সঙ্গে গল্পগুজব করেছেন। রাম নাগা বলেন, ‘‘আমরা বলেছি, পুলিশ গ্রেফতার করতে এলে কোনও বাধা দেওয়া হবে না। কিন্তু আমরা কেউই দেশবিরোধী স্লোগান দিইনি। ৯ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীর নিয়ে অনুষ্ঠানে বাইরে থেকে কয়েক জন ক্যাম্পাসে এসেছিল। তারাই দেশবিরোধী স্লোগান দেয়।’’ তা হলে গা ঢাকা দিয়েছিলেন কেন? আশুতোষের জবাব, ‘‘আমাদের গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। তাই বাধ্য হয়েছিলাম।’’ দিল্লির পুলিশ কমিশনার বি এস বস্‌সী আত্মসমর্পণ করতে বললেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনের দাবি, আগে ওই ছাত্রদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মতো গুরুতর আইনে মামলা প্রত্যাহার করাতে হবে।

শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি অজয় পট্টনায়কের দাবি, রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। সবথেকে বড় দাবি, উপাচার্য যেন কোনও ভাবেই পুলিশকে ক্যাম্পাসে ঢোকার অনুমতি না দেন। তাঁদের বক্তব্য, উপাচার্যর ডাকেই পুলিশ ভিতরে ঢুকে কানহাইয়া কুমারকে গ্রেফতার করেছিল। তার পুনরাবৃত্তি হলে আগুনে ঘি পড়বে।

উপাচার্য জগদীশ কুমার ক্যাম্পাসে পুলিশ না ডাকার ব্যাপারে মৌখিক আশ্বাস দিলেও বেশ কয়েক জন সাদা পোশাকের পুলিশ এ দিন চোখে পড়েছে। অনেকেই বলছেন, উপাচার্য মুখে যা-ই বলুন, তিনি কী করবেন, তা জানা নেই। তা ছাড়া উপাচার্যের মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতাও নেই। তিনি বড়জোর পুলিশকে অনুরোধ করতে পারেন। কিন্তু জেনএনইউ নিয়ে বিদেশের শিক্ষাবিদেরাও যে ভাবে সরব হয়েছেন, তাতে তিনি চাপে আছেন। সোমবারও বিদেশের এক দল শিক্ষাবিদ জেএনইউ নিয়ে তাঁদের ক্ষোভ জানিয়েছেন। এক অধ্যাপকের কথায়, ‘‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকতে না দিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। জগদীশ তো তা-ই করতে পারতেন!’’

পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকবে না, এমন কথা দিতে নারাজ বস্‌সী নিজেও। ফলে সংশয় আছেই। এমনিতেই বস্‌সীর ভূমিকার নিন্দা করেছেন অনেকে। কিন্তু ছাত্রদের আত্মসমর্পণ করে নির্দোষ প্রমাণ করার যে কথা তিনি বলেছেন, তাতে অনেকেই বিস্মিত। আইনজীবী মহলের প্রশ্ন, বস্‌সী কি নতুন করে সংবিধান লিখছেন? কারণ পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করলে বা চার্জশিট পেশ করলেও আদালত দোষী সাব্যস্ত না করা পর্যন্ত সে আইনত নির্দোষ। অথচ ছাত্ররা দোষী ধরে নিয়ে তাঁদের নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে বলছেন পুলিশ কমিশনার!

জেএনইউয়ের শিক্ষকদের বক্তব্য, কানহাইয়াদের বিরুদ্ধে ভুয়ো ভিডিও-র ভিত্তিতে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে। এখন প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, ওই ভিডিওটিই জাল ছিল! এখন কী হবে, প্রশ্ন তাঁদের। একটি হিন্দি চ্যানেলের সাংবাদিক গত কালই এ নিয়ে প্রতিবাদ করে পদত্যাগ করার পাশাপাশি আজ জানিয়েছেন, জেনএনইউয়ের পড়ুয়ারা সে দিন দেশবিরোধী স্লোগান দেননি!

এই পরিস্থিতিতে সাবধানে পা ফেলতে চাইছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। মঙ্গলবার থেকে সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হবে। তার আগে আজ সংসদীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডুর ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে জেএনইউ নিয়ে আলোচনার দাবি উঠলে চাপের মুখে তা মেনে নেয় সরকার। ঠিক হয়েছে ২৪ ফেব্রুয়ারি ওই আলোচনা হবে।

বাইরে পুলিশ। ভিতরে বন্ধুদের সঙ্গে গা এলিয়ে আড্ডায় মেতে ওঠা খালিদকে কুরে কুরে খাচ্ছে একটাই ব্যাপার। ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের ইতিহাস নিয়ে পিএইচডি করা খালিদের কথায়, ‘‘এই ক্যাম্পাসে গত সাত বছর ধরে পড়াশোনা বা রাজনীতি করতে গিয়ে কখনও নিজেকে মুসলিম বলে ভাবিনি। গত দশ দিন ধরে এই প্রথম মনে হচ্ছে আমি মুসলিম!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

national news umar khalid jnu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE