বিচারপতি ধনঞ্জয় চন্দ্রচূড়
আধার বৈধতা পেল সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের রায়ে। কিন্তু একই বেঞ্চ থেকে উঠে এল ভিন্ন সুর। প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন এই বেঞ্চের চূড়ান্ত রায়টি আজ ঘোষণা করেন বিচারপতি এ কে সিক্রি। ওই রায়ের বেশ কিছু বিষয়ে ভিন্নমত হওয়ায় ওই বেঞ্চেরই সদস্য বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় একটি পৃথক রায় দিয়েছেন আধার মামলায়।
বিচারপতি চন্দ্রচূড় মেনে নিয়েছেন, ভারতে এখন আধার ছাড়া বেঁচে থাকাই সম্ভব নয়। কিন্তু পৃথক রায়ে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, প্রতিটি তথ্যভাণ্ডারের সঙ্গে আধার যুক্ত হলে ব্যক্তিপরিসরের অধিকারে আঘাত আসার আশঙ্কা থাকছে। তথ্য-সুরক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় আরও বিভিন্ন অধিকার
লঙ্ঘনের আশঙ্কা রয়েছে। এই সব ফাঁকবন্ধে আইন প্রণয়নের অধিকার (তথা দায়িত্ব) যে সরকারেরই, সেটাই মনে করিয়ে দিয়েছেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়। আলাদা রায়ে তিনি মূলত আধারের বর্তমান ব্যবস্থার দশটি গলদের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল:
এক, সংবিধানের ১১০ ধারায় অর্থ বিলের যে পরিধির কথা বলা রয়েছে, আধার আইনের ব্যাপ্তি তার চেয়ে ঢের বেশি। তবু আধার বিলকে রাজ্যসভায় অর্থ বিল হিসেবে পেশ করাটা ছিল অসাংবিধানিক কাজ।
দুই, বর্তমান আধার আইনটি আদৌ আধার প্রকল্পটির উদ্দেশ্য পূরণ করতে বা এটিকে সুরক্ষা দিতে পারবে না।
তিন, মোবাইল ফোন এখন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এর সঙ্গে আধারকে যুক্ত করলে তাতে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও বক্তিপরিসরের গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে গভীর বিপদ হতে পারে। মোবাইল পরিষেবাদাতা সংস্থাগুলির অনেকে ইতিমধ্যেই অসংখ্য মানুষের আধার তথ্য সংগ্রহ করেছে। সেই তথ্য মুছে ফেলার ব্যবস্থা করার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়।
চার, কালো টাকা প্রতিরোধ আইনটি রাখার পিছনে ভাবনাটি হল প্রতিটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মালিকই কোলো টাকার লেনদেনে জড়িত থাকতে পারেন। কিন্তু যিনিই ব্যাঙ্কে খাতা খুলছেন তিনিই সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদী বা কালো টাকার লেনদেনে জড়িত বলে ধরে নেওয়া ‘দানবীয়’।
পাঁচ, বর্তমান আধার ব্যবস্থায় ব্যক্তি ধরে ধরে নজরদারির সুযোগ থাকছে।
ছয়, ‘ইউআইডিএআই’ তথা আধার কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছেন, তাঁরা ব্যক্তিপরিসরের অধিকার লঙ্ঘন করে এমন অনেক তথ্য তাঁরা জমা রাখেন। কোনও বেসরকারি সংস্থা বা তৃতীয় পক্ষ এই সব তথ্যের অপব্যহার করতে পারে। তা-ও আবার ওই তথ্য যে ব্যক্তি সম্পর্কে, তাঁর অজান্তে ও অনুমতি ছাড়াই এটা ঘটতে পারে। আধারের পরিকল্পনার ত্রুটিগুলি এখনও শোধরানো হয়নি যাতে তথ্য বেহাত হওয়া রোখা যায়। ফলে বর্তমান আধার প্রকল্প তথ্যের গোপনীয়তা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও তথ্য সুরক্ষার অধিকারকে লঙ্ঘন করছ।
সাত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আধার তথ্য নিয়ে ব্যক্তি সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্যভাণ্ডার গড়ে নিতে পারে, যাকে প্রোফাইলিং বলা হয়। ব্যক্তিবিশেষের রাজনৈতিক মত বা ঝোঁক চিহ্নিত করার কাজেও তা ব্যবহৃত হতে পারে।
আট, আধার না থাকায় সরকারি সুবিধা না-দেওয়ার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। সমাজকল্যাণ প্রকল্পের সুবিধা থেকে কাউকে বঞ্চিত করাটা তাঁর মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করা।নয়, নাগরিকদের তথ্য সুরক্ষিত রাখার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক দায় নেই ইউআইডিএআই-এর। তথ্য-সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে এমন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা কাঠামোই নেই দেশে।
দশ, সংবিধানের ১৪তম ধারাকে লঙ্ঘন করছে আধার। এই ধারায় বলা রয়েছে, ভারতে প্রত্যেক নাগরিক আইনের চোখে সমান ও প্রত্যেকে সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী।কংগ্রেস, তৃণমূল-সহ বিরোধীরা আগে থেকেই আধারের ফাঁকফোকর নিয়ে সরব ছিলেন। ভিন্ন সুরের এই পৃথক রায় নিয়ে মোদী সরকারকে এ বার ভাবতে হবে বলে মনে করছেন আইন, তথ্যপ্রযুক্তি ও রাজনীতির লোকজন। তবে বিচারপতি চন্দ্রচূড় তাঁর রায়ে লিখেছেন, আধার ভাবনায় সংবিধানবিরোধী ও অধিকার ভঙ্গের বিষয়গুলি ছিল ২০০৯ থেকেই। এই মন্তব্যের মধ্যেই স্বস্তি খুঁজছে বিজেপি। কারণ সেটা ছিল কংগ্রেসের জমানা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy