এই সেই খিড়কি মসজিদ। সঙ্গে এএসআই-এর বোর্ড। —নিজস্ব চিত্র।
সার দিয়ে পরপর তিনটি ঝাঁ চকচকে শপিং মল। তার সুবাদে দক্ষিণ দিল্লির সাকেতে প্রেস এনক্লেভ মার্গে সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত ভিড় লেগেই থাকে। শপিং মলের উল্টো দিকেই খিড়কি গ্রাম। নামে গ্রাম হলেও বাস্তবে গায়ে গায়ে লাগানো বহুতল, সরু গলিতে গাড়ির জটে দিল্লির চেনা ছবি।
এই মহল্লার মাঝখানেই দাঁড়িয়ে চতুর্দশ শতাব্দীর খিড়কি মসজিদ। তাকে ঘিরেই উত্তাল গোটা এলাকা। বাসিন্দাদের একাংশ দাবি তুলেছেন, রাণা প্রতাপের তৈরি কেল্লা দখল করে দিল্লির সুলতানরা মসজিদ তৈরি করেন। তাই একে মসজিদ না বলে খিড়কি ফোর্ট বলতে হবে। চতুর্দশ শতকের সুলতান কী করে ষোড়শ শতকের রাণার কেল্লা দখল করলেন, তার কোনও ব্যাখ্যা অবশ্য নেই!
মসজিদের প্রধান ফটকে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ-এর বোর্ড। সেখানে খিড়কি মসজিদকে সংরক্ষিত সৌধ বলে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া আছে। অথচ কয়েক মাস ধরে বারবার বোর্ডের ‘মসজিদ’ শব্দটি কারা যেন মুছে দিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে লেখা হচ্ছে। ফের মুছে দেওয়া হচ্ছে। জবাবদিহি চেয়ে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ-কে নোটিস পাঠিয়েছে দিল্লির সংখ্যালঘু কমিশন। ‘‘চুপিচুপি নয়, আমরাই মুছে দিয়েছি। পাহারাদাররা আবার মসজিদ লিখেছে। আবার মোছা হবে।’’ মসজিদের সামনে দাঁড়িয়েই সগর্বে ঘোষণা করলেন স্থানীয় বাসিন্দা দীপঙ্কর চহ্বান। কেন? জবাব মিলল, ‘‘এটা মোটেই মসজিদ নয়। রাণা প্রতাপের তৈরি কেল্লা। সুলতানরা কেল্লা দখল করেছিল বলে কি তা মসজিদ হয়ে যাবে?’’
ইতিহাস বলছে, ১৩৫১ থেকে ১৩৮৮ সালের মধ্যে ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে মসজিদটি তৈরি করান ফিরোজ শাহর প্রধানমন্ত্রী মালিক জুনা শাহ তেলঙ্গানি। মহম্মদ বিন তুঘলকের তৈরি জাহাপনাহ্ শহরে মোট ৭টি মসজিদ তৈরি করিয়েছিলেন মালিক জুনা ও তাঁর বাবা মালিক মকবুল। রাণা প্রতাপ তখন কোথায়! ইতিহাসবিদ ও দিল্লির স্থাপত্য বিশেষজ্ঞ রাণা সফভি বলেন, ‘‘খিড়কি মসজিদ তৈরি হয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দীর শেষার্ধে। তার প্রায় ২০০ বছর পরে ষোড়শ শতাব্দীতে মেবারের রাজপুত প্রতাপ সিংহের রাজত্ব। তা হলে রাণা প্রতাপের তৈরি কেল্লা দখল করে ফিরোজ শাহ মসজিদ বানাবেন কী করে?’’ কিন্তু সে ইতিহাস মানতে রাজি নন সাকেতের চহ্বাণ, সাইনি পরিবারের লোকেরা। তাঁদের দাবি, এ পাড়ায় মসজিদ রেখে নমাজের অনুমতি দেওয়া যাবে না।
রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজের সরকার ইতিহাসের পাঠ্যবই বদলে দিয়ে লিখেছে, হলদিঘাটির যুদ্ধে রাণা প্রতাপ হেরে যাননি। বরং মুঘল সম্রাট আকবরকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিলেন। সেই নতুন করে লেখা ইতিহাসেরই ছায়া এ বার দিল্লিতে। স্থানীয় সূত্রের খবর, এর পিছনে রয়েছেন সঙ্ঘ-পরিবারের স্থানীয় নেতারা। কিন্তু তাঁরা প্রকাশ্যে আসতে রাজি নন।
কেল্লা বনাম মসজিদ বিবাদের শুরু কয়েক মাস আগে। খিড়কি মসজিদে নমাজের অনুমতির দাবি জানিয়ে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন আইনজীবী শাহিদ আলি। এপ্রিলে হাইকোর্ট বলে, কেন্দ্রই এই সিদ্ধান্ত নেবে। তার পর থেকেই প্রচার শুরু হয়েছে, ওটি আদতে মসজিদই নয়।
সৌধটি ইসলামিক ও হিন্দু স্থাপত্য রীতির মিশ্রণে তৈরি বলে আরও গোল বেধেছে। স্থানীয়দের একাংশ বলছেন, মসজিদের মাথায় ছাদ রয়েছে। কেল্লার ভিতরে নিশ্চয় মন্দির ছিল। দিল্লি সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান জাফারুল ইসলাম বলেন, ‘‘এএসআই-এর কাছে জানতে চেয়েছি, ওই মসজিদ আদতে কেল্লা বলে যে প্রচার চলছে, তার খণ্ডনে তারা কী করেছে? জবাব মেলেনি।’’ ঘটনাচক্রে খিড়কি-র সামনে এএসআই শুধু সংরক্ষিত সৌধের বোর্ডই লাগিয়ে রেখেছে। মসজিদের ইতিহাসটা লেখেনি।
এখন কী করা হবে? এএসআই মুখে কুলুপ এঁটেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আধিকারিক শুধু বললেন, ‘‘আইন মেনে ব্যবস্থা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy