মৃত্যুর আগে হাসপাতালে পরেশ মোদক। পাশে বসে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী রূপাদেবী। শনিবার আগরতলার জিবি হাসপাতালে। নিজস্ব চিত্র
সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে পরিষেবা দেওয়ার প্রথায় ইতি টেনে গত শুক্রবার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে ত্রিপুরার বিজেপি সরকার। শনিবার টাকা দিতে না পেরে ত্রিপুরা মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড গোবিন্দবল্লভ পন্থ (জিবি) হাসপাতালে প্রাণ হারালেন এক দিনমজুর। যে ঘটনা ঘিরে আপাতত উত্তাল রাজ্য।
শুক্রবার জারি করা ত্রিপুরা স্বাস্থ্য দফতরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এখন থেকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য সকলকেই টাকা দিতে হবে। একমাত্র অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনার আওতাভুক্ত পরিবারগুলি বেশ কিছু ক্ষেত্রে ছাড় পাবে। অবিলম্বে এই নির্দেশ কার্যকর করতে বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের কেন্দ্র বনমালীপুরের লালবাহাদুর এলাকার বাসিন্দা পরেশ মোদক রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করতেন। নিজের ভিটেমাটি ছিল না। থাকতেন পরিচিত এক জনের বাড়ির ছাদের ঘরে। বৃহস্পতিবার মাথায় চোট নিয়ে জিবি হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। শনিবার অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা ছিল। সকালে পরেশবাবুকে যখন অপারেশন থিয়েটারের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তখন তাঁর স্ত্রী রূপাদেবীকে বলা হয়, ১০ হাজার টাকা জমা করতে হবে। নইলে অপারেশন হবে না। রূপাদেবীর কাছে ছিল শ’খানেক টাকা।
সেই খবর পেয়ে স্থানীয় এক টিভি চ্যানেলের তিন সাংবাদিক জাকির হুসেন, চুনি দেব এবং প্রণব শীল হাসপাতালে যান। পরিস্থিতি দেখে নিজেদের পকেট থেকে কয়েক হাজার টাকা রূপাদেবীর হাতে তুলে দেন তাঁরা। এগিয়ে আসেন হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও। ন’জন চিকিৎসক টাকা দেওয়ায় অপারেশন করার জন্য আশু প্রয়োজন ১০ হাজার টাকা জোগাড় হয়ে যায়। কিন্তু অপারেশনের পরে যে টাকা দরকার হবে, তার জোগাড় কোথা থেকে হবে সেই প্রশ্নে দোলাচল শুরু হয় বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসক প্রিয়াঙ্কা বণিক। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, আর একটু সময় নিয়ে শনিবার রাতে অপারেশন হবে পরেশবাবুর। কিন্তু অপারেশনের আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।
পয়সার অভাবে অপারেশন থিয়েটারের সামনে থেকে রোগীকে ফেরত পাঠানোর কথা স্বাস্থ্য অধিকর্তা ফণীন্দ্র মজুমদার জানেন। তবে রোগীর মৃত্যুর খবর জানতেন না বলেই তাঁর দাবি। ফণীন্দ্রবাবু জানান, হাসপাতাল সুপারের কাছ থেকে রিপোর্ট চেয়েছেন তিনি। ভারপ্রাপ্ত সুপার শঙ্কর চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘নতুন শুল্ক ব্যবস্থা এখনও চালু করা যায়নি।’’ কিন্তু তার পরেও কে বা কারা টাকা চাইল, তা তদন্ত করে দেখার জন্যে মেডিক্যাল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন দিনের মধ্যে তাদের রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রায়োরিটি হাউসহোল্ড (পিএইচএইচ) এবং এপিএল-ভুক্তদের যথাক্রমে ১০ ও ২০ টাকা দিয়ে কার্ড কিনে আউটডোরে দেখাতে হবে। আইসিইউ বেডের জন্য দিতে হবে ৩০০ ও ৬০০ টাকা। (৩০০ টাকা দিতে হবে অন্ত্যোদয় যোজনাভুক্ত রোগীকেও) খরচ দিতে হবে সব রকম পরীক্ষানিরীক্ষার এমনকি অক্সিজেনের জন্যও।
এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে বিরোধী দলগুলি। বিরোধী দলনেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। কংগ্রেসের পরিষদীয় নেতা গোপাল রায় বলেন, ‘‘এই ফরমান ন্যক্কারজনক এবং জনবিরোধী।’’ এরই মধ্যে পরেশ মোদকের মৃত্যু তাঁদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আজ সিপিএম ও কংগ্রেসের তরফে স্বাস্থ্য দফতর, জিবি হাসপাতাল ও আগরতলা মেডিক্যাল কলেজে বিক্ষোভ দেখানো হয়। ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে বিজেপির অন্দরেও।
তবে স্বাস্থ্য দফতর যাঁর হাতে, সেই মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব বলেছেন, ‘‘এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা যাঁরা করছেন, তাঁরা ষড়যন্ত্রকারী। আগের বামফ্রন্ট সরকার হাসপাতালে ওষুধের দাম বাবদ ২২ কোটি টাকা বকেয়া রেখে গিয়েছে।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর আয়ুষ্মান প্রকল্পে যে সমস্ত মানুষ নাম অন্তর্ভুক্ত করবেন, তাঁরা বিনা পয়সায় চিকিৎসা পরিষেবা পাবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy