Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আরও ভুলভুলাইয়ায় কারাট

হাতে বাঁশি থাকতে তখন বাজিয়ে গিয়েছেন আপন সুরে। বিদায়বেলায় জানতে চেয়েছিলেন, কোথায় বেসুর হল! সমালোচকেরা পাল্টা প্রশ্ন তুললেন, এখন ধরিয়ে দিলেও হারানো সুর কি আর ফিরবে? সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নিজের শেষ পার্টি কংগ্রেসে অনেকটা এই রকমই দশা হচ্ছে প্রকাশ কারাটের!

সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শেষ পার্টি কংগ্রেসে প্রকাশ কারাট। পাশে বৃন্দা। বুধবার বিশাখাপত্তনমে। ছবি: পিটিআই।

সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শেষ পার্টি কংগ্রেসে প্রকাশ কারাট। পাশে বৃন্দা। বুধবার বিশাখাপত্তনমে। ছবি: পিটিআই।

সন্দীপন চক্রবর্তী
বিশাখাপত্তনম শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:০৯
Share: Save:

হাতে বাঁশি থাকতে তখন বাজিয়ে গিয়েছেন আপন সুরে। বিদায়বেলায় জানতে চেয়েছিলেন, কোথায় বেসুর হল! সমালোচকেরা পাল্টা প্রশ্ন তুললেন, এখন ধরিয়ে দিলেও হারানো সুর কি আর ফিরবে?

সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নিজের শেষ পার্টি কংগ্রেসে অনেকটা এই রকমই দশা হচ্ছে প্রকাশ কারাটের! তাঁর ১০ বছরের জমানায় সিপিএম সারা দেশে একের পর এক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ক্রমশ গুরুত্ব হারিয়েছে। হরকিষেণ সিংহ সুরজিতের আমলে জাতীয় রাজনীতিতে আদায় করে নেওয়া সমীহ এখন স্রেফ অতীতের গল্প! পশ্চিমবঙ্গের মতো দুর্ভেদ্য ঘাঁটি নড়বড়ে হয়ে আছে। এমন করুণ কাহিনির মধ্যেই ২১তম পার্টি কংগ্রেসে কারাট বুঝতে চেয়েছিলেন, দলের রাজনৈতিক ও কৌশলগত লাইনে কোথায় ভুল হয়েছিল। পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চে বিতর্কটা উঠতে সব চেয়ে বেশি সমালোচনা হজম করতে হল বিদায়ী সম্পাদককেই!

বস্তুত, কারাট বাহিনীর সৌজন্যে সিপিএমের ট্র্যাজেডিও কিছুটা যেন ঘুরল কমেডির দিকে! একে তো নানা চেষ্টা করেও নিজের আমলের বিপর্যয়ের ভূত তাড়া করছে কারাটকে! তার উপরে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের কৌশল ঠিক করতে যে দলিল তিনি পেশ করেছেন, তা আসলে পরবর্তী সাধারণ সম্পাদকের হাত-পা বেঁধে দেওয়ারই নামান্তর! কারণ, এর পর থেকে কোনও রাজ্যে সিপিএম কার সঙ্গে আন্দোলনের যৌথ মঞ্চে যাবে আর কার সঙ্গেই বা নির্বাচনী সমঝোতা করবে, সে সবই প্রায় ঠিক করতে হবে দলের বই খুলে! বইয়ের কোন অধ্যায়ের কোন অনুচ্ছেদে কী আছে, সে সব দেখে অঙ্ক মিললে বন্ধুত্ব হবে। নয়তো হবে না! এই ভাবে আদৌ বাস্তবে পথ চলা সম্ভব কি না, পার্টি কংগ্রেসে হাজির প্রতিনিধিরাই সকলে নিশ্চিত নন!

পার্টি কংগ্রেসের শুরুতেই এ বার কথা হচ্ছে রাজনৈতিক ও কৌশলগত লাইনের পর্যালোচনা রিপোর্ট নিয়ে। ২৫ বছরে কী কী রাজনৈতিক ও কৌশলগত পদক্ষেপ সিপিএম নিয়েছে, তারই ভুলভ্রান্তি এই রিপোর্টের আলোচ্য। আগেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে যে রিপোর্টের পাল্টা দলিল পেশ করে কারাটকে প্রথম ধাক্কাটা দিয়ে রেখেছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি। তাঁর বিকল্প দলিলের কিছু প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করে রিপোর্ট কিছুটা পরিমার্জিত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু দলের রাজ্য ও জেলা স্তরের নেতাদের মুখ বন্ধ করবে কে? অতএব, দ্বিতীয় ধাক্কাটা কারাটকে খেতে হল পার্টি কংগ্রেসে বিতর্কের আসরে। মহারাষ্ট্রের মহেন্দ্র সিংহ, অসমের অনন্ত ডেকা, পঞ্জাবের বিজয় মিশ্র, রাজস্থানের দুলিচাঁদের মতো প্রতিনিধিরা প্রশ্ন তুললেন, দেশে সিপিএমের শক্তি তলানিতে। কখনও মায়াবতী, কখনও মুলায়ম সিংহ যাদব, কখনও জয়ললিতার হাত ধরতে গিয়ে সিপিএম তার পৃথক অস্তিত্বই খুইয়েছে। ওই ধরনের জোট করার সময় আপত্তি শোনা হয়নি! এখন এত দেরিতে আলোচনা করে আর কী লাভ!

বাংলা থেকে অমল হালদার সরাসরিই প্রশ্ন তুলেছেন, ১০ বছরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের যে সব সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হল, সেগুলো শোধরানো যাবে কী ভাবে? নন্দীগ্রাম এবং জমি অধিগ্রহণ নীতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাম নেতৃত্বের ভুলের কথাও রিপোর্টে লেখা হয়েছে। তখন তো কারাটেরাই দলের শীর্ষে ছিলেন। তাঁরা তা হলে দায় এড়াবেন কী করে? বধর্মানের প্রাক্তন জেলা সম্পাদকের আরও প্রশ্ন, সম্মেলনে এমন অনেক কৌশলই আলোচনা হয়, নথি তৈরি হয়। তার অনেক কিছুরই বাস্তবায়ন আর ঘটে না! অন্যান্য রাজ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করতে গিয়ে ভরাডুবির কথা বুধবার আলোচনায় তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের জিয়াউল আলম, প্রণব চট্টোপাধ্যায়েরাও।

বিদায়কালে কারাট অবশ্য ভাঙবেন তবু মচকাবেন না! সিপিএম সূত্রের খবর, বুধবার সম্মেলন কক্ষে অমলবাবুর বক্তৃতার পরে তাঁর কাছ থেকে ‘নোট’টা উদারতা দেখিয়ে নিজেই চেয়েছেন কারাট। আর পরে বাইরে সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘‘আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলগুলির সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাঁতে যাওয়া ভুল হয়েছিল। কেন আমরা নিজেদের শক্তি বাড়াতে পারলাম না, কেন বাম ও গণতান্ত্রিক ঐক্য গড়তে পারলাম না, সেই ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে চাইছি।’’ এত দিন পরে? কারাটের জবাব, ‘‘বেটার লেট দ্যান নেভার!’’ আর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর নিজের ভূমিকার মূল্যায়ন? হাসি ধরে রেখেই কারাট বলেছেন, ‘‘আমার না, দলের কর্মসূচি ও সিদ্ধান্তের মূল্যায়ন করা হচ্ছে। কোনও ব্যক্তির পারফরম্যান্সের বিশ্লেষণ পার্টি কংগ্রেসে করা হয় না।’’

হয়তো তা-ই! কিন্তু অতঃকিম? মায়া-মুলায়ম-জয়াদের সঙ্গে হাত মেলাতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে সিপিএম কি এ বার নিজের পায়েই দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে? ভোটে লড়বে নিজেদের শক্তিতে? এক কথায় এর সহজ উত্তর কারাটেরা বার করতে পারেননি! তাঁদের এখনকার ফর্মুলা বিজেপি বা কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার তো প্রশ্নই নেই। আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গেও জাতীয় স্তরে নির্বাচনী জোট হবে না। আন্দোলনের মঞ্চে বাম, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দলগুলি এক ছাতার তলায় আসতেই পারে। কিন্তু তার সঙ্গে ভোটে সমঝোতার সম্পর্ক নেই। কোনও রাজ্য স্তরে কারও সঙ্গে (বিজেপি-কংগ্রেস বাদে) নির্বাচনী আঁতাঁতের প্রয়োজন হলে রাজ্য নেতৃত্ব পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন। বাস্তবে কি এত যদি-কিন্তু নিয়ে চলা সম্ভব? জানতে চাইলেও কারাট এ দিন বারংবার বলেছেন, সব তাঁদের দলিলে ব্যাখ্যা করা আছে!

কিন্তু দলেই প্রশ্ন, এমনিতেই সিপিএমকে এখন কেউ আগ বাড়িয়ে খুব একটা ডাকবে না। তার উপরে নিজের রাস্তা নিজেই এত জটিল করার মানে কী! দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘‘পুরনো বিবাদ ভুলে পরিস্থিতির প্রয়োজনে জনতা পরিবার আবার এক হচ্ছে। আর আমরা তখন বন্ধুত্বের নানা শর্ত রচনা করছি!’’

ভুলের ট্র্যাজেডি কারাট-বিদায়ের সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে ‘কমেডি অব এরর্‌স’-এ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE