Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মোদী-উৎসবে মেতে উঠল বারাণসী, প্রশ্নেরা থাকল নীরব

জনতা জানত, দুপুর ৩টে নাগাদ আসার কথা নরেন্দ্র মোদীর। তবু রাস্তা ভিড়ে ছয়লাপ মোটামুটি ১১টা থেকেই।

ভক্তি: রোড শোয়ের পরে দশাশ্বমেধ ঘাটের গঙ্গা-আরতিতে নরেন্দ্র মোদী। বৃহস্পতিবার বারাণসীতে। ছবি: পিটিআই।

ভক্তি: রোড শোয়ের পরে দশাশ্বমেধ ঘাটের গঙ্গা-আরতিতে নরেন্দ্র মোদী। বৃহস্পতিবার বারাণসীতে। ছবি: পিটিআই।

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী
বারাণসী শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:১০
Share: Save:

বিমানবন্দরের টারম্যাকে দাঁড়িয়ে তাঁর বিমান। তিনি দাঁড়িয়ে কালো এসইউভি-র সিটে। গাড়ির ছাদের চৌকো ফাঁক দিয়ে শরীরের আধখানা বার করে। আর তাঁকে দেখতে সকাল থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে বারাণসী।

ভোটের ফল নিয়ে কার্যত কোনও সংশয় নেই। প্রিয়ঙ্কা বঢরা দাঁড়াচ্ছেন না, জেনে যাওয়ার পরে বাকি প্রার্থীদের নিয়েও আগ্রহ নেই। এমনকি পাঁচ বছরে সাংসদ কী কাজ করেছেন, সেই আলোচনা করার লোক খুঁজতেও আজ হয়রান হতে হবে কাশী বিশ্বনাথের শহরে। মেজাজ হল— ‘ভোট ছাড়ুন, আজ মোদী-উৎসব’!

জনতা জানত, দুপুর ৩টে নাগাদ আসার কথা নরেন্দ্র মোদীর। তবু রাস্তা ভিড়ে ছয়লাপ মোটামুটি ১১টা থেকেই। প্রধানমন্ত্রী যখন এলেন, তখন পাঁচটা পেরিয়ে গিয়েছে। ৪০ ডিগ্রির ঠা ঠা রোদ। জবজবে ঘাম। তবু যে দিকে তাকানো যায়, শুধু মানুষের মাথা। সঙ্গে মোদীর ছবি, পেল্লায় কাটআউট, বিজেপির পতাকা, কমলা-সবুজ বেলুন। বারাণসীর স্মার্ট সিটি হওয়া কতখানি এগোল, আজ তার হিসেব চাইবে কোন আহাম্মক?

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

যোগী আদিত্যনাথকে সঙ্গে নিয়ে এ বার নিজের ‘মেগা রোড শো’ শুরু করে দিলেন মোদী। পরনে গেরুয়া পাঞ্জাবি, গেরুয়া উত্তরীয়। এমনকি প্রথমেই যে ফুলে সাজানো অস্থায়ী সিঁড়িতে চড়ে হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহন মালবীয়ের মূর্তিতে মালা দিলেন, তা-ও গেরুয়া কাপড়ে মোড়া। অন্তত পোশাকে যেন তিনি আজ হিন্দুত্বের ‘পোস্টারবয়’।

মূর্তিতে মালা দিয়েই এসইউভি-তে উঠে পড়লেন। গাড়ির রুফটপ খুলে দিলেন রক্ষীরা। সেই চৌকো খুপরি দিয়েই বুক পর্যন্ত বার করে দিলেন মোদী। পিছনে রথের ঢঙে সাজানো ট্রাকে বিজেপির তাবড় নেতারা। সাংবাদিক সহকর্মীর টিপ্পনী, ‘‘যে প্রধানমন্ত্রী নিজে বারবার জঙ্গিদের নিশানায় থাকার কথা বলেন, এই ঘিঞ্জি রাস্তায়, এত ভিড়ে শুধু ভোটের জন্য অর্ধেক শরীর গাড়ির বাইরে রাখতে হচ্ছে তাঁকে!’’

লঙ্কা, পালোয়ান লস্যি, অস্‌সি মোড়, সোনারপুরা, গোধুলিয়া, বিশ্বনাথের মন্দির হয়ে যে রাস্তায় মোদী দশাশ্বমেধ ঘাটে পৌঁছলেন, তা মেরেকেটে ৬-৭ কিলোমিটার। কিন্তু ওইটুকু যেতেই লাগল প্রায় ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট। দশাশ্বমেধে অপেক্ষায় থাকা অমিত শাহ ঘড়ি দেখছিলেন বারবার। এমনিতে গঙ্গারতি প্রতিদিন শুরু হয় সন্ধে ৭টায়। কিন্তু বিশেষ অতিথির দেরির জন্যই সম্ভবত আজ তা শুরু হল বেশ দেরিতে।

দেরি হবে না-ই বা কেন? মালবীয়ের মূর্তিতে মালা দিয়ে চার দিকে ঘুরে ঘুরে জনতাকে নমস্কার করলেন মোদী। সম্ভবত মোট ছ’বার, অনেকখানি ঝুঁকে। ব্যস, তাতেই যেন গর্জন। আওয়াজ উঠছে ‘মোদী মোদী’। পুরো যাত্রাপথেই সেই মেজাজ। রাস্তায় থিকথিকে ভিড়। হাতে হাতে মোবাইল। রাস্তার দু’পাশে, প্রতি বাড়ির ছাদে, ব্যালকনিতে তিলধারণের জায়গা নেই। নেতাদের দাবি, লোক হয়েছিল প্রায় ৬ লক্ষ।

দু’দিকে একটানা হাত নেড়ে চলেছেন মোদী। নমস্কার করছেন হাসিমুখে। সাদা তোয়ালেতে মাঝে মাঝে ঘাম মুছছেন শুধু। এমনিতে তিনি নাকি সরকারি খরচ কমাতে ফুলের তোড়া পর্যন্ত নেন না। নেন শুধু একটি গোলাপ। কিন্তু এ দিন কত টন গোলাপের পাপড়ি তাঁর উপরে ঝরে পড়ল, তার হিসেব করা শক্ত।
আলোয় ছয়লাপ দশাশ্বমেধ ঘাটে প্রদীপ সাজিয়ে লেখা হয়েছে ‘ওঁ’। গঙ্গার উপরে এলইডি আলোয় লেখা ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’। পুড়ছে তারাবাজি, রংমশালও। এরই মধ্যে গঙ্গা-আরতি দেখতে দেখতে সারা ক্ষণ গানের সঙ্গে তালি দিয়ে গেলেন মোদী। তা শেষ হলে গঙ্গাপুজো করলেন গাঁদার পাপড়ি, মালা আর দুধ দিয়ে। বিরোধীরা বলেন, গঙ্গাকে ‘নিজের মা’ বলে গত বার বারাণসীতে প্রচার শুরু করেছিলেন মোদী। পাঁচ বছরে বহু বার বলেছেন গঙ্গা সাফাইয়ের কথা। কিন্তু কাজ কতটা হয়েছে, সেই হিসেব রাখা মানুষের খোঁজ এই ভিড়ে পাওয়া শক্ত। পুজোর সময়ে মোদী মন্ত্র পড়ছেন, নদীর ধারে উঠছে নতুন স্লোগান— ‘‘সুবহ বেনারস, শাম বেনারস, মোদী তেরা নাম বেনারস।’’ অন্য কেউ হলে হয়তো প্রশ্ন উঠত, একমাত্র ভোট-প্রচার ছাড়া সকাল থেকে সন্ধে, মোদী বারাণসীতে থাকলেন কবে? খরচ করেছেন সাংসদ কোটার কত শতাংশ টাকা? কিন্তু... প্রশ্ন উঠত প্রার্থী অন্য কেউ হলে!

শোনা গেল, আগামিকাল মনোনয়ন পেশের পাশাপাশি বুথকর্মীদের সঙ্গে কথা বলবেন প্রধানমন্ত্রী। আসবেন এনডিএ-র শরিক শীর্ষ নেতারাও— নীতীশ কুমার, প্রকাশ সিংহ বাদল, পনীরসেলভম। কিন্তু সে কালকের কথা। আজ শুধু মোদীর নিজের এবং দলের শক্তি আর হিন্দু ভাবাবেগ উস্কে দিতে ভক্তি প্রদর্শনের দিন।
জনা কয়েকের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, একই দিনে মোদীর রো়ড শো আর প্রিয়ঙ্কার তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী না-হওয়াকে কৌশলে ব্যবহার করছে বিজেপি। ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ধারণা যে, হার নিশ্চিত জেনেই প্রিয়ঙ্কাকে দাঁড় করাতে ভয় পেয়েছে কংগ্রেস। হোটেলের সামনে এক প্রৌঢ়ও বলছিলেন, ‘‘আগ বাড়িয়ে ‘দল চাইলে দাঁড়াতে রাজি’ বলে শেষে অন্য প্রার্থী এলে, তার ফায়দা তো বিজেপি নেবেই। গত বার তবু অরবিন্দ কেজরীবাল ছিলেন। এ বার তো ফাঁকা মাঠ।’’ ফিরতি ভিড় থেকেও এক জন বলে গেলেন, ‘‘এই রোড শো-র প্রভাব পড়বে আশপাশের আসনেও।’’

অনেকেরই মতে, বারাণসীতে জিততে যে তেমন কসরতের দরকার নেই, তা বিলক্ষণ জানেন মোদী। এ দিন তিনি জানান দিতে চেয়েছিলেন, রাজনীতির আখড়ায় তিনিই প্রধান পালোয়ান। বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, তাঁর পক্ষেই হাওয়া পুরোদমে। এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘মোদী-ঝড় নেই বলছেন? এ তো সুনামি!’’
বিমানবন্দর থেকে হোটেলের পথে সার দিয়ে হোর্ডিং। কেন ‘ফির মোদী সরকার’, তার ব্যাখ্যায়। কোথাও লেখা, ‘দেশের শান বাড়াতে’, কোথাও সুরক্ষা তো কোথাও ‘সন্ত্রাসবাদের উপরে কড়া প্রহার’-এর জন্য। বেকারত্ব বা চাষিদের দুর্দশা কমানোর প্রতিশ্রুতি চোখে পড়ল না কোথাও।

সুনামি শুনে তার ভয়াল ছবি মনে পড়ল কি সেই কারণেই?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi Politics Lok Sabha Election 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE