Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বলিউডে বস্তির শুটিং বার বার ফিরে আসে, এতটুকু উন্নয়ন আসে না ধারাবীতে

আরব সাগরের তীরে মায়াবী মুম্বই দেখেছি। দেখেছি রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাধানিষেধ সত্ত্বেও কী ভাবে প্রগলভ হচ্ছে শহর।

জীবন যেমন: ধারাবী বস্তির ঘিঞ্জি গলি। —নিজস্ব চিত্র।

জীবন যেমন: ধারাবী বস্তির ঘিঞ্জি গলি। —নিজস্ব চিত্র।

অগ্নি রায়
মুম্বই শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৫৮
Share: Save:

এক বালতি জলের জন্য পড়শিদের মধ্যে চুলোচুলি যেখানে নিত্যকর্ম, সেখানে এক পশলা স্বপ্ন ভিজিয়ে দিয়েছিল ‘পিলা বাংলা’-র ঘনস্য ঘন বসতিকে। মাহিম বদলান রোড যার পোশাকি নাম, সেই সরু গলি এখনও স্বপ্নে ডুবে। এখানেই তাঁবু পড়েছিল ‘গাল্লি বয়’-এর শুটিং দলের।

আরব সাগরের তীরে মায়াবী মুম্বই দেখেছি। দেখেছি রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাধানিষেধ সত্ত্বেও কী ভাবে প্রগলভ হচ্ছে শহর। আর মহারাষ্ট্রের কাঠফাটা দুপুরে এসে পৌঁছলাম এশিয়ার দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ বস্তি, ১০ লক্ষ মানুষের ঠিকানা ধারাবীতে। যা ওরলি সি ফেস অথবা বান্দ্রা ওরলি সি লিঙ্কের আকাশ-ছোঁয়া স্কাইলাইনের কাছে, অথচ কতই না দূরত্ব! ২০০২ সালে ‘স্লামডগ মিলিয়োনেয়ার’ মুক্তি পাওয়ার পরে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে মুম্বইয়ের মহাবস্তিটিকে ঘিরে কৌতূহল এতটাই, যে আট ফুট বাই আট ফুট খুপরি বা বিশ্বের অন্যতম সরু গলি দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ভিন্ দেশি পর্যটকেরাও।

মাহিম বদলান রোড যেখানে শেষ হয়েছে, সেই গণেশ মন্দিরের উল্টো দিকে হুপু ময়দানে এসে দাঁড়িয়েছি। এখানে স্থানীয় র‌্যাপারদের সঙ্গে নিয়মিত অনুশীলন করতেন রণবীর সিংহ। শুটিং-এর দল তাঁবু গুটিয়ে চলে গিয়েছে, কিন্তু তার স্মৃতি রূপকথার কাচের মতো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে গোটা অঞ্চলে। স্থানীয় তরুণ বিলাস কাক্কির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে চর্চা করার চেষ্টা করতে দেখি, ভিড় জমে গেল এবং সমস্বর স্মৃতিচারণ! “এই গলি দিয়ে রজনীকান্ত কালো রঙের মার্সিডিজে ঢুকত। ‘গাল্লি বয়’-এর অনেক আগেই এখানে ‘কালা’-র শুটিং হয়েছে কি না। রণবীর আসত গভীর রাতে। ধারাবী ঘুমিয়ে পড়ার পরে।” এই ধারাবী কি কখনও ঘুমোয়? দেখে অবশ্য মনে হয় না। এর বিচিত্র অর্থনীতি এবং যাপনকে ঘিরে জটিল এক জ্যামিতি, গলি-রেলিং-সিঁড়ি-উঠোন-রান্নাঘর-দোকানপাটের। সব কিছুর মধ্যে চলছে যেন পুতুলের সংসার, পুতুলের রান্নাবাটি! বাণিজ্য, চামড়ার মিনি উৎপাদন কেন্দ্র, পাঁপড় বানানোর উঠোন, অন্ধকার ঘরের মধ্যে কাপড়ে চুমকি বসানোর রোশনাই।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে গেলাম একটি খোঁদলের সামনে। আসলে দোকান। একটি মানুষের বেশি আঁটে না সেই দোকানে। গত পনেরো বছর এখানেই সেলাইকল চালাচ্ছেন সাবিত্রী বড়েগড়ি। বছর চল্লিশের এই মহিলার কথায়, “আমার বাবা যখন আমার বয়সি ছিল, তখন থেকে ফাইলবন্দি করে রেখেছে রেশন কার্ড, বিজলির বিল, আরও সব কাগজ। সেই থেকে শুনছি এখানে নাকি বস্তি ভেঙে বড় বিল্ডিং হবে। আমাদের ফ্ল্যাট দেবে।” প্রাণ খুলে হাসছেন সাবিত্রী। এই পরিবেশে তাঁর হাসিটা শোনাচ্ছে নিয়তির কণ্ঠস্বরের মতো।

গলিগুলির পরিসরের অভাব, তুচ্ছতা আর ছ্যাঁকা লাগা বাস্তবতাকে হয়তো কিছুটা সমীহ করেই কোনও দল এসে পোস্টার লাগায়নি। অন্তত পায়ে হেঁটে যতটা ঘুরলাম, চোখে পড়ল না। তবে সংলগ্ন ময়দানে (যেখানে সিনেমার শুটিং হয়েছিল) ভোটবাবুদের যাতায়াত শুরু হয়ে গিয়েছে। শিবসেনা, এনসিপি, কংগ্রেসের জনসভা হয়ে গিয়েছে। হাসির রেশ ধরে রেখেই সাবিত্রী বলছেন, “প্রত্যেকবারই ভোটের আগে এসে বলে বস্তির সমস্যার সমাধান হবে। ডেভেলপমেন্ট হবে। বিধায়ক বর্ষা গায়কোয়াড় নাকি খুব উঠে পড়ে লেগেছেন এখানকার সুরাহা করার। দেখি শেষ পর্যন্ত কী হয়।”

ধারাবীর গলিতে সাবিত্রী বড়েগড়ির দোকান। —নিজস্ব চিত্র।

মৎস্যজীবী কোলিরা বহু বছর ধরে এই খাঁড়ি অঞ্চল বুজিয়ে গড়ে তুলেছিলেন জনপদ। মাছের ব্যবসায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে বেড়া, টিন, কাঠ, পাথর, সিমেন্ট দিয়ে খুপরি বানিয়ে ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। বিক্রিও হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এখানকার অর্ধেকের হাতে আইনি কাগজ নেই। “আগে তো এখানে ছোটা রাজনের রাজ চলত। আমাদের জন্য অনেক ভালও করেছে। সে জেলে চলে যাওয়ার পর ওর শাগরেদ ডি কে রাও সাহায্য করত। এই যে গলিটায় দাঁড়িয়ে আছেন, এর একদম শেষ মাথায় রাওয়ের বাড়ি। ও মার্ডার কেসে ফেঁসে যাওয়ার পর ঘরে তালা লাগিয়ে গিয়েছে পুলিশ।” গলা খাটো করে বললেন মধু তারাপোড়ে। স্থানীয় বাসিন্দা, চামড়ার বেল্টের অর্ডার ধরার কাজ করে বহু অসংগঠিত শ্রমিকের নেতাস্থানীয়। বালা সাহেব ঠাকরের নাম পর্যন্ত মুখে আনতে চাইলেন না, ভয়ে না ভক্তিতে বোঝা গেল না। শুধু এটুকু বললেন, “বালা সাহেবের মতো ছিল রাজ। উদ্ধব নয়। কিন্তু রাজ তো কিছুই করতে পারল না।”

গলির পর গলি টপকাচ্ছি। মোবিল, চামড়া, গঁদের আঠা, কাবাব, কর্পূর মেলানো বিচিত্র গন্ধের সহাবস্থান। একরাশ পাঁপড় বেলে রোদে রেখেছেন নেহা শরমিন। নালার এপাশে ওপাশে ছটাক জায়গা বের করে। মাল ডেলিভারি দেওয়ার তাড়া। কাজে ছেদ পড়ায় যথেষ্ট বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “লিখে দেবেন আমরা এখানেই থাকব। এটাই আমাদের দেশ। ফ্ল্যাট হলে এখানেই যদি জায়গা দেয় ভাল, না হলে আগুন জ্বলবে। এ ব্যাপারে কিন্তু আমরা এককাট্টা।”

স্বপ্ন দেখার জোর না বেঁচে থাকার লড়াই? ভাবতে ভাবতে ়এসে দাঁড়ালাম বান্দ্রা কুরলা কমপ্লেক্সের পাঁচতারা মুম্বই জীবনে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE