Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

গেরস্থালি ফেলে ৪২ সেকেন্ডে দৌড়

সরকার মানতে রাজি নয়, কিন্তু ‘জিরো লাইন’ ঘেঁষা এই গ্রাম কার্যত যুদ্ধক্ষেত্রই!

দৈনন্দিন: পাক মর্টারে ভেঙেছে ছাদ। নৌশেরার ডিং গ্রামে। নিজস্ব চিত্র

দৈনন্দিন: পাক মর্টারে ভেঙেছে ছাদ। নৌশেরার ডিং গ্রামে। নিজস্ব চিত্র

অনমিত্র সেনগুপ্ত
ডিং (রাজৌরি) শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৯ ০২:২৫
Share: Save:

ঘড়ি ধরে ৪২ সেকেন্ড। পাকিস্তানি গোলা থেকে বাঁচতে ওইটুকু সময়ই পান জম্মুর ডিং গ্রামের বাসিন্দারা।

এ প্রান্তে ভারতীয় সেনার ছাউনি। যা লক্ষ্য করে পাক সেনার নিয়মিত হামলা। নৌশেরার নিয়্ন্ত্রণরেখায় ভারতের শেষ গ্রাম ডিং সিঁটিয়ে থাকে মাঝখানে। ‘শেলিং’ এখানে রোজকার ঘটনা। পাক কামানের বিস্ফোরণের শব্দ ও অর্ধবৃত্তাকার গতিপথে গোলা এসে পড়া— এই দুইয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান সর্বোচ্চ ৪২ সেকেন্ডের! সেনাবাহিনীই বলে রেখেছে গ্রামবাসীদের, পাকিস্তানের দিক থেকে গোলার শোনা মাত্রই খেতের কাজ, গরুছাগল চরানো, সব ফেলে ৪২ সেকেন্ডের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে হবে নিরাপদ জায়গা খুঁজে। এক বার শুরু হলে অন্তত তিন থেকে চার ঘণ্টার ধাক্কা। কখন শেলিং শেষ হবে, জানে না কেউ। আর হ্যাঁ, লুকোনোর জন্য কোনও বাঙ্কার নেই এই গ্রামে।

সরকার মানতে রাজি নয়, কিন্তু ‘জিরো লাইন’ ঘেঁষা এই গ্রাম কার্যত যুদ্ধক্ষেত্রই! প্রতি দিনের জীবন যেখানে অনিশ্চয়তায় ভরা। ভোট আসে, চলেও যায়। গোলাগুলির মধ্যে জীবন বয়ে যায় একই ধাঁচে। বদলায় না কিছুই।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

পাকা বাড়ির সারি শেষ হতেই খেত। তার পরেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে হিমালয়। এ-পারে ভারত, ও-পারে পাকিস্তান। গ্রামের সীমানার শুরুতে সেনা ছাউনি। পাকিস্তানের শেল-মর্টারের লক্ষ্য সেই ছাউনি হলেও ফি-দিন গোলা এসে পড়ে খেতে, উঠোনে, ছাদে। বাদ যায় না গ্রামের একমাত্র স্কুলবাড়িটাও! সেনার বক্তব্য, ডিং লক্ষ্য করে পরিকল্পিত ভাবেই হামলা চালায় পাকিস্তান। কারণ, গ্রামবাসীরা পালালে জঙ্গি অনুপ্রবেশে সুবিধে হয়। নিয়ন্ত্রণরেখার উপরে থাকা গ্রামগুলো আজও এ দেশের ‘ফার্স্ট লাইন অব ডিফেন্স।’ অর্থাৎ, ও-পারের তৎপরতার খবরাখবর পেতে এই গ্রামবাসীরাই সেনার বড় ভরসা।

গ্রামের শেষ বাড়িটি সত্যপাল সিংহের। দোতলা বাড়ি পাকিস্তানের গোলা-স্প্লিন্টারের আঘাতে কার্যত শতছিদ্র। দিন দুয়েক আগে সত্যপালের বাড়ির ছাদে গোলা পড়েছে। বরাতজোরে বেঁচে গিয়েছেন। সত্যপাল বলছিলেন, “ছাদে বসে চা খাচ্ছিলাম। বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনেই ঘরের ভিতর ঢুকে যাই। নিমেষের মধ্যে ছাদের খাটিয়ায় বোমা এসে পড়ে। ছাদের একটা অংশ ভেঙে পড়ে নীচের গোয়ালে। এক চুলের জন্য বেঁচে যাই।”

কপালজোরে বেঁচেছেন সুনীতি দেবীও। ক’দিন আগে খেতে কাজ করছিলেন তিনি। হঠাৎ সর্‌সর্‌ আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারেন গোলা আসছে। সেনার প্রশিক্ষণ মেনে দ্রুত শুয়ে পড়েন সুনীতি। হাত চারেক দূরে এসে পড়ে গোলা। ফাটেনি। তাই প্রাণে বেঁচে যান। বছরখানেক আগে পরীক্ষা চলার সময়ে গোলা এসে পড়ে আগুন ধরে গিয়েছিল স্কুলবাড়িতে। তার পরে দূরে নতুন করে তৈরি হয় স্কুল। বাড়তি পথ উজিয়েই সেখানে পড়তে যেতে হয় গ্রামের ছেলেমেয়েদের।

গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, ২০১৬ সালের প্রথম সার্জিকাল স্ট্রাইকের পর থেকেই বেড়েছিল মর্টার হামলা। আর বালাকোট অভিযানের পরে তো তীব্রতা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। গত তিন বছরে অন্তত পাঁচ হাজার পাকিস্তানি গোলা এসে পড়েছে এই গ্রামে। জবাব দিয়েছে ভারতীয় সেনাও। গ্রামবাসীরা তাই বলছেন, “আমাদের মতো পাকিস্তানের দিকে থাকা গ্রামবাসীদেরও ত্রাহিমাম দশা।”

দৈনন্দিন জীবনের এই তো হাল। স্কুলবাড়ি দূরে সরানো হলেও গোলাগুলিতে রোজই বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। ফলে রাজ্যের অন্য প্রান্তের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে স্থানীয় পড়ুয়ারা। আবার বাচ্চারা স্কুলে গেলেও আতঙ্কে কাঁটা হয়ে থাকেন অভিভাবকেরা। পরিস্থিতি উত্তরোত্তর খারাপ হওয়ায় অনেকেই দূরের হস্টেলে বা আত্মীয়দের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন সন্তানদের।

স্বাধীনতার এত বছর পরেও গ্রামে নেই মোবাইল সংযোগ। হয়তো নিয়ন্ত্রণরেখা-ঘেঁষা বলে ইচ্ছে করেই মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’! ফেসবুকে স্টেটাস দেখা হোক বা গুলিগোলায় আহতের জন্য অ্যাম্বুল্যান্স ডাকা— আগে পাড়ি দিতে হবে দু-তিন কিলোমিটার পথ। তবে স্ক্রিনে ফুটে উঠবে মোবাইলের টাওয়ার। স্থানীয়দের অভিযোগ, উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ টাকা দিল্লি থেকে জম্মু হয়ে রাজৌরি-নৌশেরা আসতে আসতেই উধাও হয়ে যায়। তাই গ্রামের কাঁচা রাস্তা কাঁচাই থাকে। বাঙ্কার তৈরির টাকা শুধুমাত্র বাঙ্কারের জমিটুকু চিহ্নিত হওয়ার পরেই ফুরিয়ে যায়। বাঙ্কার আর হয়ে ওঠে না।

অসহায় ডিং তাই জীবন সঁপে দেয় ভাগ্যের হাতে। প্রাণের মায়ায় গ্রামে পা দেন না আত্মীয়েরা। গ্রামের ছেলেদের বিয়ের বয়স গড়িয়ে যায়। অথচ ‘যুদ্ধের গ্রামে’ মেয়ে পাঠাতে চায় না কেউ।

ডিং রয়ে যায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে। ভিন রাজ্যের সাংবাদিককে দেখে গ্রামবাসীরা বলেন, “অনেক হয়েছে। এ বার শান্তি ফিরুক গ্রামে। বন্ধ হোক গোলাগুলি।” কিন্তু চাইলেই তা হবে, এমন নিশ্চয়তা কোথায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE