Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘শুধু ধর্ম নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে কি?’

বর্তমানে নরেন্দ্র মোদীর দল এবং সঙ্ঘ পরিবার দক্ষিণ ভারতের একমাত্র যে-এলাকায় জাঁকিয়ে বসেছে, তা হল এই কন্যাকুমারী।

সিঁড়ি বেয়ে: কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দপুরমে। নিজস্ব চিত্র

সিঁড়ি বেয়ে: কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দপুরমে। নিজস্ব চিত্র

অগ্নি রায়
কন্যাকুমারী শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:৩৩
Share: Save:

দীর্ঘ পথশ্রমেই সম্ভবত চোখটা লেগে গিয়েছিল। ঝিমুনি ভেঙে গেল পাশে বসা চালকের কণ্ঠস্বরে।

‘‘স্যর, দিস ইজ এন্ড অব তামিলনাড়! এন্ড অব ইন্ডিয়া!’’

চালক, দর্শন ডিমেলো খাস দক্ষিণী। কন্যাকুমারী পৌঁছে তাঁর উত্তেজিত হওয়ার কারণটা নেহাতই পেশাদারি প্রতিক্রিয়া মাত্র। তবে কথাটা শুনে আমার পলকের জন্য মায়াবিভ্রম তৈরি হল! কাশ্মীর থেকে শুরু। মাঝখানে একটানা উড়ান, রেল আর সড়কপথে শেষ পর্যন্ত কন্যাকুমারী! তার মধ্যে কত বিচিত্র ভোটের ভূগোল, লড়াইয়ের আখ্যান। এবং বেঁচে থাকার রূপকথা!

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

সামনেই তিন রঙের তিন সমুদ্র। বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর আর আরব সাগর। দূরের আকাশরেখায় সেই শিলা, যার উপরে বিবেকানন্দ ধ্যানে বসেছিলেন ভবিষ্যৎ ভারতের সন্ধানে। বিবাদ নয়, বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ, সমন্বয় ও শান্তির হিন্দুধর্মের বার্তা নিয়ে শিকাগো পাড়ি দিয়েছিলেন এখান থেকেই।

বর্তমানে নরেন্দ্র মোদীর দল এবং সঙ্ঘ পরিবার দক্ষিণ ভারতের একমাত্র যে-এলাকায় জাঁকিয়ে বসেছে, তা হল এই কন্যাকুমারী। তামিলনাড়ুর একমাত্র বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী পুন রাধাকৃষ্ণন গত লোকসভায় জিতেছিলেন এই কন্যাকুমারী থেকেই। খ্রিস্টান-প্রধান এই এলাকায় হিন্দুদের এক ছাতার তলায় আনতে সিমলের নরেন্দ্র দত্তকে প্রচারে ব্যবহার করার কোনও বিশেষ কৌশল কি রয়েছে নরেন্দ্র মোদীর?

নাগরকোই রোডে বিজেপির নির্বাচনী অফিসে দেখা হল রাধাকৃষ্ণনের ব্যক্তিগত সচিব রাজ ভারতের সঙ্গে। যিনি নিঃসন্দেহে ‘থট রিডার’! প্রশ্ন করার আগেই উত্তর ছিটকে এল: “আমরা কিন্তু ব্র্যান্ড বিবেকানন্দের বিপণন করি না এখানে! বিকাশই রাধাকৃষ্ণনের সব চেয়ে বড় জোর। উড়ালপুল থেকে কোকোনাট এক্সপোর্ট জ়োন— কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী থাকার সুবাদে এখানে অনেক কিছু করেছেন তিনি।” শুধু বললেনই না, হাতে ধরিয়ে দিলেন ২৫ পাতার একটি পুস্তিকা যার নাম ‘প্রসপারিং কন্যাকুমারী’।

নির্বাচনী অফিসের বাইরে কিন্তু আলাদা গুঞ্জন। মজার ব্যাপার হল, খ্রিস্টান-প্রধান (৪৮ শতাংশ) এই এলাকায় দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ই সংখ্যাগুরু! রয়েছেন পাঁচ শতাংশ মুসলিমও। উচ্চবিত্ত খ্রিস্টানদের একটি ছোট অংশ এবং সামগ্রিক হিন্দু ভোট ব্যাঙ্ককে বিজেপি পকেটে পুরেছে যথাক্রমে বিকাশের প্রচার এবং আরএসএসের নিয়মিত ক্লাসের মধ্য দিয়ে। ফ্রুট জুসের একটি পুরনো দোকানের ক্যাশবাক্সে বসা ম্যানেজার, সাদা ধুতি গুটিয়ে পরা সুদর্শন নায়ার যেমন গলা নামিয়ে বলছেন, ‘‘গত এক মাসে সঙ্ঘের নেতারা অন্তত দেড়শো ছোট ছোট ক্লাস নিয়েছেন গোটা এলাকায়। হিন্দুত্বের পরম প্রচারক বিবেকানন্দের কথা তো ওঁরা বলছেনই আমাদের। আরও একটা নতুন কথা বলেছেন।’’ চার পাশে খদ্দের দেখে গলাটা আরও নামিয়ে বললেন ম্যানেজার, “গত পাঁচ বছরে এই গোটা এলাকায় একটিও নতুন গির্জা তৈরি হয়নি। যা হয়েছে মন্দিরই হয়েছে! বুঝলেন তো ব্যাপারখানা!’’

যা বোঝার, মোক্ষম বুঝলাম! আকণ্ঠ তৃপ্তিতে নিমজ্জিত ওই রস-ম্যানেজারকে ছেড়ে আবার পথে। যে-ঘাট থেকে বিবেকানন্দ শিলায় যাওয়ার স্পিডবোট আধ ঘণ্টা অন্তর ছাড়ে, সেখানে লাগানো রয়েছে সারি দেওয়া জেলে নৌকাও। মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু নৌকাগুলির মূলে যেন ম্লানভাব। ৭৩ কিলোমিটার লম্বা উপকূলরেখা। জেলে গ্রামের সংখ্যা ৪৮। তিন লক্ষ মানুষের রুটিরুজির সংস্থান হয় মাছ বিক্রি, ডিপ-সি ফিশিং, এমনকি শার্ক হান্টিং থেকেও। এখান থেকে চিন, জাপানের মতো দেশে যায় প্যাকেট করা হাঙরের মাংস।

এই বিরাট অর্থনীতির উপরে বড় আঘাত আসছে ভেবে আতঙ্কিত মৎস্যজীবীরা। কোস্টাল পিপল ডেভেলপমেন্ট মন্ত্রম (মৎস্যজীবীদের সংগঠন)-এর প্রেসিডেন্ট এ মারিয়াদাসন জানাচ্ছেন, সামনে ভোট বলে কন্যাকুমারীতে কেন্দ্রীয় সাগরমালা প্রকল্পের অধীনে ৩০ হাজার কোটি টাকার ‘ইন্টারন্যাশনাল কন্টেনার ট্রান্সশিপমেন্ট টার্মিনাল’ থমকে রয়েছে। এক কথায় এটি একটি নতুন প্রস্তাবিত বন্দর, যেখানে বাইরে থেকে বড় জাহাজে কোল কন্টেনার আসবে (এক-একটি জাহাজ প্রায় দেড় কিলোমিটার লম্বা)। ছোট ছোট জাহাজে সেই কন্টেনার চলে যাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। মারিয়াদাসন বললেন, ‘‘আদানি গোষ্ঠীর মেগা কয়লাখনি রয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু সে-দেশের সরকারের সঙ্গে আদানিদের কয়লা-বাণিজ্য নিয়ে সমস্যা হওয়ায় সেই খনি থেকে কয়লা তারা পাঠাবে ভারতে। এ-সব তারই প্রস্তুতি।” মৎসজীবী সম্প্রদায়ের বক্তব্য, এই বিরাট প্রকল্পের চাপে ভীষণ ভাবে ব্যাহত হবে তাঁদের রুজি। অভিযোগ, যে-হেতু এই মৎস্যজীবীদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা নগণ্য, তাই ভোটের ভিত হারানোর ভয়ও নেই বিজেপির।

পিছনে তিনরঙা সমুদ্রকে ফেলে বিবেকানন্দ শিলা থেকে ফেরার বোট ধরেছি। কন্যাকুমারী থেকে তিরুঅনন্তপুরম হয়ে দিল্লি। এই যাত্রার শেষ পথ-বন্ধু সাহুল হামিদের শাঁখ, মালা-সহ বিভিন্ন পর্যটন সামগ্রীর দোকান কাছেই। ব্যবসা সূত্রে বিবেকানন্দপুরমে এসেছিলেন। ‘‘বাজপেয়ীকে স্যর এখনও সবাই এখানে পছন্দ করে। কিন্তু এই বিজেপি তো আমাদের পাকিস্তানে পাঠাতে চায়। অথচ দেখুন বিবেকানন্দের শিলা দেখতে আসেন যাঁরা, তাঁদের জন্য কাজ করে চলেছি বিশ বছর ধরে।’’

ঘাটে পৌঁছে গিয়েছে বোট। সাহুল বলে চলেছেন, ‘‘আমি রুটি খাব না ইডলি না বিফ, সেটা সরকার ঠিক করে দেবে কেন? নর্থ ইন্ডিয়ার এক জনকে তো মেরেই ফেলা হল গরু রাখার জন্য। আমরা চাই, গোটা ভারত এগোক। ধর্ম নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে কি? দিল্লির সব খবরই তো আমরা চ্যানেল, ফেসবুকেই পাই।’’

এক ঝলকে সামনে চলে এল কাশ্মীর থেকে দাদরি হয়ে নর্মদা জেলার আলো-অন্ধকার মুখগুলো। এ বারের ভোটের ভবিষ্যৎ যা-ই হোক, অন্তত কিছু বিষয়ে খুব স্পষ্ট ভাবে একই সুরে বাজছে গোটা দেশ।

কাশ্মীর থেকে কুমারিকা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE