Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
general-election-2019-journalist

ভোটের সময় আসেন নেতা, বাকি সময়ে বাঘ

রামপুরিয়া মহব। পিলিভিট ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের একেবারে গা ঘেঁষা এই গ্রামে বাস অন্তত শ’সাতেক বাঙালির। ‘বাঘের বাড়ি’ থেকে দূরত্ব মেরেকেটে ৫০০-৭০০ মিটার। মাঝে দাঁড়িয়ে শুধু বৈদ্যুতিক তারের বেড়া। কোথাও আবার তা-ও নেই!

পিলিভিটের বাঙালিরা। নিজস্ব চিত্র

পিলিভিটের বাঙালিরা। নিজস্ব চিত্র

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী
পিলিভিট শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৩৭
Share: Save:

চোখে তেমন দেখেন না। জবাব দিয়েছে হাঁটুও। তবু প্লাস্টিকের টেবিলে চায়ের কাপ আর হাতড়ে খোঁজা হাতে নোনতা বিস্কুট গুঁজে দিতে দিতে একশো ছুঁইছুঁই সুরুবালা দেবনাথ বলছিলেন, ‘‘এটুকু খাও বাবা। এই আমাদের খাবার। আর আমরা বাঘের!’’

রামপুরিয়া মহব। পিলিভিট ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের একেবারে গা ঘেঁষা এই গ্রামে বাস অন্তত শ’সাতেক বাঙালির। ‘বাঘের বাড়ি’ থেকে দূরত্ব মেরেকেটে ৫০০-৭০০ মিটার। মাঝে দাঁড়িয়ে শুধু বৈদ্যুতিক তারের বেড়া। কোথাও আবার তা-ও নেই! তাই বাঙালি এখানে মাঝেমধ্যেই বাঘের খাদ্য!

স্থানীয় বাসিন্দা মিঠুন দে বলছিলেন, ‘‘পিলিভিটে বাঙালি নেহাত কম নয়। প্রায় দু’আড়াই লক্ষ। কিন্তু অধিকাংশই এই তল্লাটে। সারদা, চুকা নদীর ধারে। জঙ্গলের গা ঘেঁষা একের পর এক গ্রামে।’’ অভিযোগ, পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তানে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁরা ভারতে এসেছেন সেই ১৯৫৯-৬০-৬২ সালে। কিন্তু এত দিন পরেও এ দেশ তাঁদের আপন করে নেয়নি।

বাংলা বলা সাংবাদিক এসেছেন শুনে এক ডাকে জড়ো হয়ে গেল প্রায় পুরো গ্রাম। দুলাল মিশ্র, অরিজিৎ দে, জীবন হীরা, দুলাল মিশ্রদের দাবি, ‘‘স্রেফ গত ৭-৮ মাসে এই অঞ্চলে বাঘের হানায় প্রাণ গিয়েছে ৭-৮ জনের। দু’তিন বছরে বাঘের পেটে গিয়েছেন ৩০-৩৫ জন। কোনওক্রমে প্রাণ হাতে করে বেঁচে থাকা।’’

অভিমানী গলায় হরেকৃষ্ণ বিশ্বাস বলছিলেন, ‘‘আমরা যারা সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে জমিজমা, ভিটে-মাটি ছেড়ে এ দেশে এসেছিলাম, খোঁজ নিয়ে দেখুন, পুনর্বাসনে তাঁদের এক বড় অংশেরই ঠাঁই হয়েছে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যে। জঙ্গলের গা ঘেঁষে। ওই যে কথায় আছে না, বাঘের সঙ্গে শত্রুকেই লড়াই করতে পাঠানো ভাল। দু’পক্ষের যে কেউ মরলেই ক্ষতি নেই।’’

নিমাই অধিকারী, সুখরঞ্জন হালদার, দয়াল অধিকারীদের কথায়, তাঁদের সব থেকে বড় সমস্যা উত্তরাধিকার সূত্রে জমি হস্তান্তর করতে না পারা। প্রায় সকলেই এক বাক্যে বলছিলেন, ‘‘মরার আগে সামান্য জমিটুকু যদি খাতায়-কলমে ছেলের নামে লিখে দিয়ে যেতে না পারি, তা হলে সে কী ভাবে বাঁচে বলো দেখি।’’ অভিযোগ, পুনর্বাসনের সময়ে সরকার সামান্য জমি দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু পাট্টা হাতে আসেনি এখনও। ফলে পায়ে পায়ে অসুবিধা, অশান্তি। এক জন যেমন রসিকতা করেই বললেন, ‘‘বাঘ নাকি সরকারি অফিসার— কার থাবা বেশি ভয়ঙ্কর, তা ঠাওর করা শক্ত। আগে শুনেছিলাম জমির লিজ ৯৯ বছরের। এখন সরকারি অফিসে বলছে ৩৫! এই তো সে দিন প্রতিবাদে জেলাশাসকের অফিস ঘেরাও করা হয়েছিল।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কয়েক ঘণ্টা গ্রামে কাটিয়ে শোনা গেল, এখনও এখানকার ৪০-৫০ শতাংশ মানুষের ভোটার কার্ড নেই। সরকারি চাকরি তো দূরস্থান, বাঙালি নাম দেখলে কাজ দিতে চায় না অনেক বেসরকারি কারখানাও। কোনও কাজ নিয়ে গেলে অধিকাংশ সরকারি অফিসে বরাদ্দ থাকে লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা। গ্রামে হাতুড়ে ছাড়া ডাক্তার তেমন নেই। ভরসা প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের সরকারি হাসপাতাল। যেখানে ডাক্তারের দেখা পেয়ে জলদি ওষুধ হাতে আসা ঈশ্বর দর্শনের সামিল।’’

মিঠুনের কথায়, ‘‘এখানে ডাকলে ডাক্তার আসেন না। স্কুলে নিয়মিত শিক্ষক আসেন না। ভোট ছাড়া নেতারা আসেন না। নিয়ম করে আসে একমাত্র বাঘই। কখনও কাছের ক্ষেতে, কখনও রাস্তায়, তো কখনও স্কুলের ক্লাসরুমে!’’ এ বার নাকি সবাই মিলে ভোট বয়কট করার কথা ভেবেছিলেন। ‘‘এত যেখানে বঞ্চনা, জীবনে নিরাপত্তার এত অভাব, সেখানে ভোট দিয়ে কী করব বলুন তো?’’— প্রশ্ন গ্রামের মাথাদের। কিন্তু শেষ সময়ে সব হিসেব পাল্টে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী! তাঁকে দেখেই নাকি সকলে ঠিক করেছেন এই শেষ বার ভোটে ভরসা রাখবেন তাঁরা। প্রতিটা ভোট নাকি পড়বে পদ্মে। যদি তাতেও পরিস্থিতি না বদলায়, তখন ব্যালট বয়কট।

সত্যিই বাঘের হানায় ত্রস্ত এই গ্রামের অগাধ আস্থা মোদীজির সিংহবিক্রমে। প্রায় প্রতি বাড়ির ছাদে বিজেপির পতাকা। বাসিন্দারা বুক ঠুকে বলছেন সব ভোট পদ্মে পড়ার কথা। কিন্তু গত পাঁচ বছরে পরিস্থিতি কি কিছু পাল্টেছে? সুরাহা হয়েছে কোনও সমস্যার? প্রশ্ন শেষ না হতেই সম্মিলিত উত্তর, ‘‘মোদীজি আসার পরেই ঘরে গ্যাস এসেছে। বিদ্যুতের পোল বসেছে গ্রামে। বাড়িতে শৌচালয়ও এই জমানায়।’’ তালিকা লম্বা।

তবে যে এখনই শুনলাম বাঘের থাবায় অধিকাংশ মৃত্যুই জঙ্গলে জ্বালানির কাঠ আনতে গিয়ে! এই যে ক’জন বললেন, দিনের পর দিন কারেন্ট না থাকার কথা! এই যে বলা হল, খাতায়-কলমে প্রতি বাড়িতে শৌচালয় তৈরি দেখিয়েও আসলে তা তৈরি হচ্ছে না বহু জায়গায়!

ঝাঁঝালো গলায় জবাব এল, ‘‘গ্যাস তো এসেছে। কাঠ আনতে হয় অত দাম দিয়ে সিলিন্ডার কিনতে পারি না বলে। বিদ্যুতের পোলে গণ্ডগোল হলে, হাজার ডেকেও লোক আসে না সরকারি অফিস থেকে। শৌচালয়ের টাকা চুরি করে সরকারি কর্মী। মোদী কী করবেন?’’

সমর্থনের আসল কারণ অবশ্য লুকিয়ে শেষ যুক্তিতে। তাঁরা বলছিলেন, ‘‘সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে ভিটেমাটি খুইয়ে এ দেশে চলে আসার স্মৃতি এখনও টাটকা। দগদগে অত্যাচারের দিনগুলো। এক বিজেপিই তো শুধু হিন্দুদের কথা বলে। তাই না?’’

পড়ন্ত বেলায় টের পেলাম, এখানে অভাব বিস্তর। অভিযোগ অনন্ত। কিন্তু মোদীজি ভগবান! সম্ভবত শেষ ভরসাও। ফিরতি পথে গাড়িতে বসে মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল প্রশ্ন। সেই কারণেই কি জ্বালানির খোঁজে জঙ্গলে পা রেখে বাঘের সামনে পড়ার নিয়তি মেনেও গ্যাস সংযোগ দেনেওয়ালার প্রতি এমন অসীম আনুগত্য?

বিখ্যাত সিনেমার সেই বহু আলোচিত সংলাপ মনে করিয়ে দিলেন এক পরিচিত ভদ্রলোক। ‘যায় যদি যাক প্রাণ,... রাজা ভগবান।’

অবিকল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 Tiger Reserve Pilibhit
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE