Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নিষিদ্ধ ম্যাগি, বিক্রি বন্ধ করল নেসলেও

দু’মিনিটের জাদু আপাতত উধাও হয়ে গেল ভারতীয় বাজার থেকে। সিসা আর আজিনামোতো নিয়ে বিতর্কের জেরে তিন দশকেরও বেশি সময়ের জনপ্রিয়তায় এখন ভাটার টান।

সাংবাদিকদের মুখোমুখি নেসলের সিইও পল বুল্ক। শুক্রবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: এএফপি।

সাংবাদিকদের মুখোমুখি নেসলের সিইও পল বুল্ক। শুক্রবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: এএফপি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৫ ০৩:২৩
Share: Save:

দু’মিনিটের জাদু আপাতত উধাও হয়ে গেল ভারতীয় বাজার থেকে। সিসা আর আজিনামোতো নিয়ে বিতর্কের জেরে তিন দশকেরও বেশি সময়ের জনপ্রিয়তায় এখন ভাটার টান।

সুইস সংস্থা খোদ নেসলে গত কাল গভীর রাতে এক বিবৃতি দিয়ে ভারতের বাজার থেকে তাদের নুডল্স তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা হওয়ায় নেসলে-র সিইও পল বুল্ক তড়িঘড়ি সুইৎজারল্যান্ড থেকে উড়ে এসে আজ দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করে বলেছেন, ‘‘ক্রেতাদের বিশ্বাস ফিরে পাওয়াই মূল লক্ষ্য আমাদের।’’

অন্য দিকে, ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ামক সংস্থা ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অব ইন্ডিয়া’ (এফএসএসএআই) আজ ম্যাগির ন’ধরনের নুডল্সই এখানকার বাজার থেকে তুলে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। ভারতে ম্যাগির উৎপাদন এবং বিক্রির উপরেও নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে তারা। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নড্ডা বলেন, ‘‘সব রাজ্য থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কাছে যে রিপোর্ট এসেছে তা থেকে স্পষ্ট, খাদ্য নিরাপত্তা ও মানের দিকে গুরুত্ব দেয়নি নেসলে। তাই তাদের সব নুডল্‌স ভারতের বাজার থেকে তুলে নেওয়া হচ্ছে।’’

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য আজ বলেন, ‘‘এখানে ম্যাগির ৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। আমাদের রাজ্যে আপত্তিকর কিছু পাইনি।’’ সারা দেশে ম্যাগি নিষিদ্ধ হওয়ার পরে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান কী হবে? স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশে ম্যাগি নিষিদ্ধ করেছে। সুতরাং, আমাদের রাজ্যেও তা নিষিদ্ধ।’’

এ দিন সাংবাদিক বৈঠকেও পল বুল্ক দাবি করেন, ম্যাগি ক্ষতিকারক নয়। তাঁর দাবি, ‘যুক্তিহীন কিছু কারণ’ থেকে ‘বিভ্রান্তি’ তৈরি হয়েছে, যা গ্রাহকদের বিশ্বাসের ভিত নড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু ম্যাগির মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (এমএসজি) বা আজিনামোতো এবং সিসা মিলেছে বলে ভারতের বিভিন্ন পরীক্ষাগারে যে দাবি করা হচ্ছে, তা নিয়ে কী বলেছেন পল? তাঁর জবাব, ‘‘পরিবেশের সর্বত্রই সিসা রয়েছে। ম্যাগিতে তা নির্ধারিত মাত্রার মধ্যে রয়েছে। আর নেসলে ম্যাগিতে এমএসজি যোগ করে না।’’ তাঁর দাবি, ‘‘স্বাদ বাড়াতে সাধারণত যে এমএসজি (ই৬২১) ব্যবহার করা হয়, ভারতে আমরা সেটা দিই না। বরং চিনেবাদামের প্রোটিন, পেঁয়াজ গুঁড়ো এবং ময়দা থেকে এই গ্লুটামেট ম্যাগিতে যায়। তা ক্ষতিকর নয়।’’ নেসলে-র দাবি, ম্যাগির প্যাকেটে ‘নো অ্যাডেড এমএসজি’ কথাটি


সরছে বিজ্ঞাপনও। সেক্টর ৫-এর এক চায়ের দোকানে। ছবি: শৌভিক দে।

উল্লেখ করা থাকে। তা থেকেই সম্ভবত বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। তাই এই উল্লেখ প্যাকেট থেকে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থা।

দিল্লিতে আজ যে সময় পল বুল্কের সাংবাদিক বৈঠক চলছে, সেই সময়েই এফএসএসএআই ঘোষণা করে, ক্ষতিকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ভারতের বাজার থেকে ম্যাগির সব ধরনের নুডল্স সরিয়ে দেওয়া হবে। যা শুনে বুল্ক বলেন, ‘‘আমরা প্রশাসনের সঙ্গে বসে বিতর্ক মেটানোর চেষ্টা করছি।’’ আপাতত সব স্টক তুলে নিলেও ভারতে দ্রুত ম্যাগিকে ফিরিয়ে আনতে চান বুল্ক। তবে ঠিক কবে, তা বলেননি তিনি।

এই সিদ্ধান্তে সংস্থার কত ক্ষতি হল, তা নিয়েও মন্তব্য করতে চাননি বুল্ক। শুধু বলেছেন, ক্রেতাদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার উপরেই জোর দিচ্ছে সংস্থা। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা ভারতে একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা করছি। এখানে ব্যবসা করার অভিজ্ঞতা ভাল। তার জন্যই আজ আমি এখানে হাজির হয়েছি। আমি নিশ্চিত, খুব তাড়াতাড়ি ভারতীয় বাজারে ফিরে আসছে ম্যাগি।’’

একই সঙ্গে এ দিন ম্যাগির নানা সময়ের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর অমিতাভ বচ্চন, মাধুরী দীক্ষিত এবং প্রীতি জিন্টার পাশে দাঁড়ানোর বার্তাও দিয়েছে নেসলে।

সিসা এবং আজিনামোতো নিয়ে আপত্তি ওঠায় গোটা ভারতেই এখন ম্যাগি বিক্রি বা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। তা ছাড়াও, এফএসএসএআই শো কজ নোটিস ধরিয়েছে নেসলকে। তাদের ন’টা নুডল্‌সের উপর থেকে পণ্য-অনুমোদন কেন তুলে নেওয়া হবে না, সেই মর্মে ১৫ দিনের মধ্যে নেসলেকে জবাব দিতে বলা হয়েছে।

তবে এর মধ্যেও নেসলেকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গ। মহারাষ্ট্রের ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ জানিয়েছে, সে রাজ্যে ম্যাগির নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, নির্ধারিত মাত্রার মধ্যেই রয়েছে সিসার পরিমাণ।

আর পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, রাজ্য সরকার ম্যাগির আটটি নমুনা পরীক্ষা করিয়েছে। তার মধ্যে তিনটে কলকাতা পুরসভা এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। বাকি পাঁচটা নেওয়া হয়েছিল কলকাতার বাইরে থেকে।

নমুনাগুলি রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের অধীন ‘খাদ্যে ভেজাল নিরীক্ষণ পরীক্ষা কেন্দ্র’ এবং আর একটি বেসরকারি পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠানো হয়। কিন্তু কোনওটিতেই সিসার পরিমাণ সহনমাত্রার চেয়ে বেশি মেলেনি। এ প্রসঙ্গে মুখমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নমুনা পরীক্ষা চলতে থাকবে। আরও তদন্ত প্রয়োজন। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

কেন্দ্রের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য মন্তব্য করতে চাননি। শুধু বলেন, ‘‘কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার আগে নিষিদ্ধ করব কী ভাবে! বিষয়টি যৌথ তালিকাভুক্ত। কেন্দ্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আমার কথার মধ্যেই উত্তর রয়েছে।’’

বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র প্রশ্ন তোলেন, ‘‘নেসলে এক অর্থে দায় স্বীকার করছে। তা হলে মুখ্যমন্ত্রী কেন তাদের হয়ে সওয়াল করছেন?’’ তাঁর কটাক্ষ, ‘‘উনি নিজে ম্যাগি খান কি না, জানি না। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে উনি কেন ঝুঁকি নিচ্ছেন?’’ সূর্যবাবুর মন্তব্য শুনে মমতার প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমরা কাউকে আড়াল করছি না। দোষ পাওয়া না গেলে আমরা কী করব!’’

ভারত থেকে ম্যাগি আমদানি ও বিক্রির উপরে আপাতত নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে নেপাল এবং সিঙ্গাপুর। বিতর্কের ঢেউ ছুঁয়েছে সুদূর লন্ডনেও। সেখানে ভারত থেকে আমদানি করা ম্যাগি নুডলসে সিসার পরিমাণ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রিটিশ ফুড স্ট্যান্ডার্ড এজেন্সি। ছবি: শৌভিক দে

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE