প্রধানমন্ত্রী হয়ে ইস্তক নরেন্দ্র মোদী বলে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে মর্যাদা দিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য সহযোগিতার পরিবেশ চান তিনি। রাজ্যগুলির হাতে তুলে দিতে চান অনেক বেশি ক্ষমতা। অথচ বাস্তবে তাঁর সরকার উল্টো কাজই করছে বলে দিল্লিতে তোপ দাগলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অভিযোগ, ‘‘নবান্নের পাশাপাশি সমান্তরাল সরকার চালানো হচ্ছে রাজভবন থেকেও! রাজ্যপাল নিজে থেকেই চিঠি লিখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে বলছেন আধাসেনা দেওয়ার জন্য। রাজ্য এর কিছুই জানে না। পরে বিষয়টি জেনে আমি স্তম্ভিত।’’ তৃণমূল নেত্রীর প্রশ্ন, ‘‘এটা কি আদৌ সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা? বরং বলা উচিত, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক।’’
রাজ্য সরকারকে অন্ধকারে রেখেই রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে চিঠি লিখে পুরভোটের জন্য আধাসেনা চেয়েছিলেন। কেন্দ্র শেষ পর্যন্ত রাজ্যপালের কথা মেনে না নিলেও দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরীবালের কনক্লেভের মঞ্চ থেকে মমতা আজ ঘোষণা করেছেন, ‘‘এই রকম সমান্তরাল সরকার চালানো মেনে নেওয়া হবে না।’’ সূত্রের খবর সন্ধেয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে বৈঠকেও বিষয়টি তাঁকে জানিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। পরে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মমতা অবশ্য কোনও উত্তর দেননি। রাজনাথের কাছে পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা ও পাহাড়ে ধস নামার ঘটনা) মোকাবিলায় আর্থিক সহায়তা দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছেন, জাতীয় ত্রাণ তহবিল থেকে এ ব্যাপারে প্রাপ্য টাকা এখনও হাতে আসেনি রাজ্যের।
কেন্দ্র থেকে প্রাপ্য না পাওয়ার অভিযোগ আগেও করেছেন মমতা। আজ কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে কনক্লেভের মঞ্চেও এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁর আক্রমণের মূল বিষয়টি ছিল ‘সমান্তরাল সরকার চালানো’ নিয়ে। সম্প্রতি যে বিতর্কের বোমাটি ফাটিয়েছেন রাজ্যপাল ত্রিপাঠী। আধাসেনা চেয়ে তাঁর ওই চিঠির কথা প্রথমে বিন্দুবিসর্গও জানত না নবান্ন। আজ এ ব্যাপারে শুধু সরবই হননি মুখ্যমন্ত্রী, এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী যাতে হস্তক্ষেপ করেন, সেই দাবিও তুলেছেন। শুধু রাজ্যপালের ওই চিঠিই নয়, রাজ্যের অধিকারে পড়ে এমন বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ এবং সামাজিক প্রকল্পগুলি থেকে কেন্দ্রের হাত তুলে নেওয়ার অভিযোগ সামনে এনে মোদী সরকারের তুমুল সমালোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অভিযোগ, ‘‘আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের তালিকাভুক্ত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সামান্য কোনও ঘটনা ঘটলেই রাজ্যের সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করেই সিবিআই, র, ইডি-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাকে রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’’
রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছে বামেরাও। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন কলকাতায় বলেছেন, ‘‘সরকারে না থাকলেও আমাদের অবস্থান বদলায়নি। রাজ্যপাল আধাসামরিক বাহিনী চেয়ে কেন্দ্রকে চিঠি দিতে পারেন না। তা চাইতে পারে নির্বাচন কমিশন। সেটা তাদের এক্তিয়ার। সুপ্রিম কোর্টও বলেছে এ কথা।’’ তবে একই প্রশ্নে মমতাকেও বিঁধতে ছাড়েননি সূর্যকান্ত।
তাঁর কথায়, ‘‘এই রাজ্যে সব ধরনের সাংবিধানিক কমিশনের এক্তিয়ারই মুখ্যমন্ত্রী ভেঙেছেন। এখন তিনিই অন্যের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন!’’
রাজ্যপাল ত্রিপাঠীর কাজকর্ম নিয়ে গত কয়েক মাস ধরেই অস্বস্তি বাড়ছে তৃণমূল নেতৃত্বের। তাঁদের অভিযোগ, রাজ্যপালের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করছেন বিজেপির রাজ্য নেতারা। তাঁরা যখন-তখন ফোন করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ্যপালকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করছেন। অভিযোগ, রাজ্যপালও কথায় কথায় বিভিন্ন দফতরের বিভাগীয় অফিসারদের ডেকে পাঠাচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। শাসক দলের উষ্মা বাড়িয়ে বিজেপি নেত্রী তথা অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে সর্বক্ষণের নিরাপত্তারক্ষী দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন রাজ্যপাল। রাজ্যপালের এমন পদক্ষেপের পিছনে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছে শাসক দল। তবে আগে বিষয়টি নিয়ে এ ভাবে মুখ খোলেননি মমতা বা দলের কেউ। আজ দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রী সমাবেশের মঞ্চকে তিনি সেই কাজে লাগালেন। জাতীয় স্তরের অনুষ্ঠান। সেখানে বিষয়টি নিয়ে সরব হলে জাতীয় রাজনীতিতে ও সংবাদমাধ্যমে সাড়া পড়বে, সম্ভবত সেই অঙ্ক কষেও দিল্লিতে এসে তোপ দেগেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে।
দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে কেন্দ্রের সঙ্গে নানা সংঘাতে জড়িয়েছেন অরবিন্দ কেজরীবালও। তাঁর অভিযোগ, আমলা নিয়োগ থেকে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ— ভোটে হেরে মোদী এখন উপ-রাজ্যপালের মাধ্যমে দিল্লি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন। কেজরীবালের মতে, দিল্লিই নয়, অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও একই সমস্যার শিকার। তাই গণতন্ত্রের স্বার্থে অ-বিজেপি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে কেন্দ্র-বিরোধী মঞ্চ গড়তে তৎপর হন কেজরীবাল-মমতারা। অগস্টে মমতার দিল্লি সফরের সময়ে ঠিক হয়, চলতি মাসের শেষে একটি কনক্লেভ হবে দিল্লিতে। কনক্লেভের শীর্ষক, সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। মমতার কথায়, ‘‘সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা— কথাটা শুনতে খুবই ভাল। কিন্তু যা হচ্ছে সেটাকে আদৌ সহযোগিতামূলক আদৌ বলা যায় না। ’’
বিজেপি নেতৃত্বকে বিঁধে তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্য, ‘‘রাজনৈতিক ভাবে বিরোধী দলগুলির সঙ্গে লড়তে না পেরে এরা সমান্তরাল সরকার চালানোর চেষ্টা করছেন অনেক জায়গাতেই। দিল্লিতেও এই ঘটনা ঘটছে। রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিরাও তো নির্বাচনের মাধ্যমে আসেন। অথচ তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে আধাসেনা দিয়ে ভোট করানোর।’’ কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের সীমারেখা মনে করিয়ে দিতে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ কেবল নীতি নির্ধারণ করা। প্রতিরক্ষা, রেলের মতো কিছু ক্ষেত্র বাদে রাজ্যের কোনও বিষয়ে কেন্দ্রের নাক গলানোই উচিত নয়।’’ খাগড়াগড় বিস্ফোরণ প্রসঙ্গ টেনে মমতার অভিযোগ, ‘‘গত বছর দুর্গাপুজোর সময় বাংলায় দু’জন বোমা বিস্ফোরণে মারা গিয়েছেন। কেন্দ্র তখন জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র প্রতিনিধি পাঠায়। অথচ গত মাসে অনেক লোক মধ্যপ্রদেশে বিস্ফোরণেই মারা গিয়েছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমনটা করা হয়নি।’’ কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, মধ্যপ্রদেশে মৃত্যু ঘটেছে সিলিন্ডার ফেটে। সেটা দুর্ঘটনা। ফলে এনআইএ-র প্রতিনিধি পাঠানোর প্রশ্নই নেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে খাগড়াগড়ের ঘটনাটি বিস্ফোরণ। তা নিয়ে তদন্ত আবশ্যক। মমতা অবশ্য এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁর অভিযোগ, মধ্যপ্রদেশের বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকার আড়াল করছে।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগের পাশাপাশি মমতা সরব হন কেন্দ্রের অর্থনৈতিক বঞ্চনা নিয়েও। গত কাল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে বৈঠকে এ নিয়ে রাজ্যের অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি। আজ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘কেন্দ্র যা করছে তা ঠিক নয়। চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশের বিষয়টি বড় করে দেখিয়ে প্রচার করা হচ্ছে যে, কেন্দ্র নাকি বরাদ্দ বাড়িয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল, ওরা যা বাড়িয়েছে, তার থেকে বেশি নিয়ে নিয়েছে।’’ মোট ৫৬টি কেন্দ্রীয় প্রকল্প থেকে দেয় অর্থের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া (সর্বশিক্ষা অভিযান, মি়ড ডে মিল-এর মতো সামাজিক প্রকল্প রয়েছে যার মধ্যে), অনগ্রসর এলাকা উন্নয়ন তহবিলের মতো প্রকল্পগুলি গুটিয়ে দেওয়া, অর্ধেক কাজ এগোনোর পরে জেএনএনইউআরএম-এর মতো প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মমতা।
বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ কমানো নিয়ে বক্তব্য, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপরিশ অনুযায়ী রাজ্যকে কেন্দ্রীয় করের অনেক বেশি অংশ (৪২%) দেওয়া হচ্ছে। আর যে প্রকল্পগুলিতে কেন্দ্র টাকা দেওয়া বন্ধ করেছে, সেগুলি নিয়ে সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, এর ফলে রাজ্য কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মানার দায় থেকে মুক্ত হল। তারা নিজেদের প্রয়োজন মতো প্রকল্পগুলি চালাতে পারবে। যেমন, রাজ্য সরকার যদি মনে করে পুলিশের আধুনিকীকরণে টাকা দেওয়ার দরকার নেই তবে না-ও দিতে পারে। মমতার মতে এটা সুবিধাবাদ ছাড়া কিছু নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy