লখনউয়ের গোমতীনগরের জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশে সমাজবাদী পার্টির নেতা কিরণময় নন্দ।
রাজনীতির প্রবাদ বলে দিল্লির তখতের রাস্তা লখনউ হয়ে যায়। কিন্তু এ কোন লখনউ!
গোমতীনগর যেন এক টুকরো কলকাতা!
গত কাল দুপুরেই দেখা গিয়েছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঘাস ফুলের ছবির কাট আউটে একটু একটু করে ঢাকা পড়ছে গোমতীর এ পার (ও পারে পুরনো লখনউ শহর)। আজ গোমতীনগর দৃশ্যত আরও অচেনা! গোটা এলাকাটাই ছেয়ে গিয়েছে হোর্ডিংয়ে। রাস্তার দু’ধার, গোল চকের চারপাশ— বাদ নেই কিছুই। তবে শুধু মমতার ছবিতে নয়। নতুন কাট আউটে রাতারাতি ঘাস ফুলের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে সাইকেল, মমতার পাশাপাশি অখিলেশ সিংহ যাদব। একেবারে ভোজবাজি যেন!
লখনউতে তৃণমূল নেত্রী যে আজ সভা করবেন সেই ঘোষণা তিনি করেন সপ্তাহখানেক আগে। নবাবের শহর জানাচ্ছে, তা নিয়ে গোড়ায় এখানে বিশেষ সাড়া ছিল না। কিন্তু গতকাল মমতাকে অভ্যর্থনা জানাতে অখিলেশ বিমানবন্দরে চলে যাওয়াতেই বার্তা চলে যায় সমাজবাদী পার্টি শিবিরে। মমতার সভা ‘সফল’ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন সপা কর্মীরা। তার পর আজ যা হল, তা মমতার রাজনৈতিক জীবনে এক প্রকার নয়া যাত্রার শুরু!
গত কাল ধর্মতলায় প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি হুমকি দিয়ে মমতা বলেছিলেন, ‘‘হয় মরব, নয় বাঁচব, কিন্তু মোদীকে ভারতবর্ষের রাজনীতি থেকে সরাব!’’ আর আজ সেই কথাটাই হিন্দিবলয়ের রাজনীতির হৃদয়খণ্ডে দাঁড়িয়ে আরও সপাটে জানিয়ে দিলেন তৃণমূল নেত্রী। বললেন,‘‘নোট বন্দি করে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলেছেন যিনি, সেই মোদীকে এ বার ভোটবন্দি করুন!’’ সেই সঙ্গে ডাক দিলেন জাতীয় স্তরে বিরোধী ঐক্য অটুট রাখারও।
অতিথি মমতা। মঙ্গলবার পটনায় লালু প্রসাদের বাড়িতে। সঙ্গে রাবড়ী দেবীও।
রাজনৈতিক শিবিরের মতে, যার অর্থ একটাই, জাতীয় রাজনীতিতে মোদীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজেকে এক্কেবারে ফ্রন্টলাইনে রাখতে চাইছেন মমতা। এই সমরে ক্রমশই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র করে তোলার রাজনীতিতে নেমেছেন তিনি! যাতে ২০১৯ সালের ভোটে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির মধ্যে জোট তৈরি হলে তাঁর উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
সে দিক থেকে লখনউয়ে সভা থেকে উৎসাহই পাওয়ার কথা মমতার। মোদী-বিরোধী তাঁর প্রতিটি আক্রমণের সময় দৃশ্যত সাড়া পেয়েছেন ভিড় থেকে। সেই ভিড়ে মহিলা ও যুবকের সংখ্যাই ছিল বেশি। দিব্যি বোঝা যাচ্ছিল, এ হল অখিলেশ বাহিনী! তা ছাড়া মঞ্চে মমতার সঙ্গে বসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী রবিদাস, কারামন্ত্রী নরেশ উত্তম-সহ অখিলেশ মন্ত্রিসভার চার সদস্য। মমতাকে যে সপা গুরুত্ব দিচ্ছে তা এই ছবিতেও ছিল পরিষ্কার। সপা সূত্রে বলা হচ্ছে, আড়ালে থাকলেও খোদ মুলায়ম সিংহের সমর্থনও যে মমতার সঙ্গে রয়েছে তা-ও একটি বিষয়ে স্পষ্ট। তা হল মঞ্চে মুলায়ম ঘনিষ্ঠ দলের সহ-সভাপতি কিরণময় নন্দের উপস্থিতি। অবশ্য লখনউ-র রাজনীতি বলছে, মমতাকে এমন উষ্ণ অভ্যর্থনা দেওয়ার নেপথ্যে অখিলেশ-মুলায়মের নিজেদের স্বার্থও রয়েছে। রাজ্যে বিধানসভা ভোট আসন্ন। সেখানে সপা-র মূল লড়াই বিজেপি তথা মোদী-অমিত শাহের বিরুদ্ধে। সেই প্রেক্ষাপটে মোদী বিরোধী কোনও রাজনৈতিক শক্তি লখনউ এসে সপা-র পাশে দাঁড়ালে তা ইতিবাচক বইকি।
তবে মমতার এই ‘বাড়াবাড়িতে’ চটেছে বিজেপি। তৃণমূলকে পাল্টা চাপে ফেলতে সারদা তথা চিট ফান্ড তদন্তের খাতা খোলার তৎপরতা যেমন প্রশাসনিক স্তরে শুরু হয়ে গিয়েছে। তেমনই মমতা ও কালো টাকার সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশ্যে তোপ দাগা শুরু করেছেন অমিত শাহরা। গত কাল কলকাতার সভা থেকে তার জবাব এক প্রস্ত দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। আজ লখনউতে মমতা তুলে আনেন সেই প্রসঙ্গ। বিজেপি-র তরফে অমিত শাহের নামে বিহারে জমি কেনারপ্রসঙ্গ টেনে বলেন, “ছুপারুস্তম যে কে, তা সবাই জানে। সবাই চোর আর মোদী কেবল সন্ত। বিজেপি নেতারা সব জানত। ওই সিদ্ধান্তের আগে সব টাকা বিদেশে পাঠিয়েছে।”
লখনউতে সভা শেষ করেই আজ পটনার বিমান ধরেন মমতা। তবে লখনউয়ে সভার শেষে যতটা চওড়া হাসি ছিল তৃণমূল নেত্রীর মুখে ততটা পটনা পৌঁছনোর পর ততটা উচ্ছ্বসিত দেখা যায়নি তাঁকে। কারণ ছবিটাও পাল্টে গিয়েছে যে! লখনউয়ে যেখানে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতার জন্য বিমানবন্দরে এসেছিলেন, সেখানে পটনা বিমানবন্দরে নীতীশ কুমার দূরস্থান, মন্ত্রিসভার তস্য কোনও ছোট মন্ত্রীরও দেখা মেলেনি। এমনিতেই নোট বাতিলের প্রশ্নে মমতা-নীতীশ মতাদর্শের মৌলিক ফারাক রয়েছে। মমতা কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি তুললেও, এর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন নীতীশ। শুধু সংযুক্ত জনতা নয়, মমতা সম্পর্কে এ দিন শৈত্য দেখা যায় লালু প্রসাদের দলেও। তবে চেষ্টায় ত্রুটি রাখেননি মমতা। রাতেই তিনি চলে যান লালুর বাসভবনে। লালু প্রসাদ অসুস্থ। বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোচ্ছেন না। তৃণমূল নেত্রী জানান, তাঁর সঙ্গে দেখা করে তিনি অনুরোধ করেছেন, কাল পটনার সভায় যেন স্ত্রী রাবড়ী দেবীকে পাঠান লালু প্রসাদ। যদিও সে ব্যাপারেও আশ্বাস দেননি লালু। শুধু জানিয়েছেন, দলের রাজ্য সভাপতি রামচন্দ্র কুরবেকে পাঠানোর চেষ্টা করবেন তিনি।
ফলে গোটা দিন ধরে যে বিরোধী ঐক্যের কথা তিনি আউড়েছেন, পটনার মাটিতে তাতে যে চিড় ধরেছে তা বুঝতে পারেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তবু সাহসী মুখ দেখিয়ে বলেন, ‘‘আমি তো বলেইছি লড়াই চলবে। ফের দিল্লি যাব আমি!’’
(সহ প্রতিবেদন: দিবাকর রায়)
—নিজস্ব চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy