রোজ সকালে গাছের সঙ্গে কথা বলতে হয় তাঁকে। গাছেরা রাগ করে কাছে না গেলে। ঋতু পাল্টায়। পাল্টাতে থাকে গাছেদের মেজাজ!
আমলকি গাছে আমলকি ফলবে, ফলবে আম-কাঁঠাল। শীতের ডালিয়ারা বড় হবে, গাঁদা ফুলেরা টব আলো করে থাকবে। শুধু তাঁকে চলে যেতে হবে ওদের ছেড়ে। শুধু তাঁকে নয়, তাঁদের যেতে হবে কুড়ি বছরের গেরস্থালি ছেড়ে, নতুন জায়গায় নতুন গেরস্থালি বসাতে।
আর কিছু ক্ষণ পরে সন্ধে নামবে আগরতলার মার্কস এঙ্গেলস সরণিতে। নাগরিক রোদের এখন ঝিমোনোর সময়। পুলিশি ব্যারিকেড, সশস্ত্র রক্ষীর দল, জেড নিরাপত্তায় মোড়া বাংলো বাড়ির ভিতরে তখন প্রবল ব্যস্ততা। প্যাকিং বাক্স আর কাপড়ে মোড়া সংসার তার জায়গা বদলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তদারকিতে ব্যস্ত পাঞ্চালি ভট্টাচার্য। এ সব কাজের ঝক্কি যে তাঁরই উপরে! বাংলোর দোতলার বসার ঘরে এই মুহূর্তে লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে যিনি বসে আছেন মুখে চিরকালীন প্রশান্তি নিয়ে, সেই মানিক সরকার যে এ সব কাজে বিশেষ পারঙ্গম তেমনটা নয়। তবে রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ সামলানোর পাশাপাশি সংগঠনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তিনিই সামলাচ্ছেন গত দু’দশক ধরে।
এ বারে অবশ্য একটা ভীষণ ভারী কাজের ভার আর বহন করতে হবে না মানিক সরকারকে। তাঁর মুখ্যমন্ত্রী পদের আগে ‘প্রাক্তন’ শব্দটি জুড়ে গিয়েছে। তাই সরকারি বাংলোয় আর অতিরিক্ত এক দিনও থাকতে চান না মানিক ও পাঞ্চালি। কিন্তু যাবেন কোথায় তাঁরা? নিজেদের বাড়িই তো নেই! তাই আপাতত এই দম্পতি ঠাঁই নেবেন সিপিএম রাজ্য দফতরের গেস্ট রুমে। পরে অন্য কোনও বাড়িতে চলে যাবেন তাঁরা।
নতুন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব শপথ নেবেন আগামী ৯ মার্চ, শুক্রবার। মানিক সরকার চান তার আগেই মুখ্যমন্ত্রীর বাংলো ছেড়ে চলে যেতে। যেতে তো চান, কিন্তু কুড়ি বছরে একটু একটু করে সাজানো সংসার কি এক কথায় তুলে নিয়ে যাওয়া যায়? বাড়ি ভর্তি বইয়ের কী হবে? পাঞ্চালি জানান, বেশ কিছু বই তাঁরা দিয়ে দিয়েছেন রাজ্য সরকারের বীরচন্দ্র স্টেট সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে। লেনিন রচনাবলী, দাস ক্যাপিটাল, কার্ল মার্কস সমেত অনেক বই দিয়েছেন সিপিএমের দলীয় লাইব্রেরিতে। আর বাংলাদেশের কয়েকটি প্রকাশনার বেশ কিছু বই রেখেছেন নিজেদের কাছে। আগরতলার কৃষ্ণনগরে পাঞ্চালির বাপেরবাড়ির একটি ঘরে ঠাঁই পাচ্ছে সে সব গ্রন্থ।
‘‘ওর দিকে আর একটু বেশি নজর দিতে পারব এ বার। অবশ্য ওকে নিয়ে আগেও ব্যস্ততা ছিলই। কখন ফিরবে, কখন খাবে, নজর তো রাখতেই হত। তৃণমূল স্তরে মেয়েদের নিয়ে কাজ করি। আমাদের সংগঠন ‘চেতনা-ইনস্টিটিউট অব উইমেন স্টাডিজ’-এর সামাজিক কাজ চলে। সে কাজেও আরও জোর দেব।’’ মুখ্যমন্ত্রীর দোতলা বাংলোর একতলার বসার ঘরে পাঞ্চালির কথা চলতে থাকে।
৩ মার্চ, ভোটগণনার দিন নিজের কেন্দ্র ধনপুরের গণনা নিয়ে বিস্তর গণ্ডগোল হয়েছিল। রাত বাড়ছিল। ৯টা-১০টা-১১টা-সাড়ে ১১টা— মানিক সরকারের সাদা গাড়ি যখন বাংলোর ভিতরে ঢুকল, তখন উঠোনে সার বাঁধা লোকজন। শুধু পাঞ্চালিই নন, এ বাড়িতে থাকা লোকজন, অফিস স্টাফেরা কেউই বাড়ি যেতে চাননি। গাড়ি থেকে নেমে তাঁদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মানিক বলেছিলেন, ‘‘কী হয়েছে? কিছুই হয়নি। ভোটে তো হারজিত আছেই। রাত হয়েছে। কাল কথা হবে।’’ খানিকটা স্বগতোক্তির মতো বলে চলেন পাঞ্চালি, ‘‘ওর ওই হাসি দেখে বড় কষ্ট হয়েছিল, জানেন।’’
তাঁর ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ পাঞ্চালির সঙ্গে সে দিন আর কোনও কথা হয়নি মানিক সরকারের? ‘‘হয়েছিল। ও নিজের মতো করেই বলছিল, ‘আমরা তো আন্দোলনের মধ্যেই আছি। দোষ-ত্রুটি আছে। কিন্তু মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে।’’
কোনও দিন সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেননি পাঞ্চালি। রিকশা করে যাতায়াত করেছেন, বাজার করেছেন। নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে ঘোরেননি। আরও পাঁচ জন মহিলার মতো গেরস্থালি সামলেছেন। এই জীবনযাত্রাই তাই তাঁকে করে তুলেছে অনন্যসাধারণ। চলতি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যা শুধু বেমানানই নয়, যেন কেমনতর! ‘‘তাতে কী! আমি তো চিরকাল এতেই অভ্যস্ত।’’
চা-বিস্কুট আসে, কাজুবাদাম আর মিষ্টিও। বাড়ি বদলানোর তাণ্ডবের মাঝেও অতিথি সৎকারে ত্রুটি নেই। ‘‘খেয়ে নিন, এখানকার খুব বিখ্যাত মিষ্টি।’’ গৃহিণীর নিজের জন্যও চা আসে। বিস্কুট এলেও ফিরে যায়, অতিথির প্লেটের অব্যবহৃত বিস্কুটই অক্লেশে তুলে নিয়ে বলেন, ‘‘আর দিও না, ওর বিস্কুট পড়ে আছে, ওতেই হয়ে যাবে।’’ দূরবীন দিয়েও মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী সুলভ আচরণের কোনও কিছুই নজরে আসে না!
দোতলার বসার ঘরে গৃহকর্তা। যাওয়ার আগে একবার দেখা করার জন্য উঠতেই পাঞ্চালি নিজেই নিয়ে যান উপরে। সিঁড়ির পাশের দেওয়ালের ছবিগুলি খুলে ফেলা হয়েছে। ‘‘রবীন্দ্রনাথের খুব সুন্দর একটা ছবি টাঙানো ছিল।’’ বলেন পাঞ্চালি।
আরও পড়ুন: ত্রিপুরায় হিংসা থামান, মোদীকে চিঠি সিপিএমের
বাইরের পৃথিবীর কাছে পরিচিত সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামায় এখন নেই মানিক সরকার। পুরোদস্তুর বাড়ির পোশাক। স্মিত হেসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা মানুষজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন মানিক। বর্তমান না প্রাক্তন, কোনও তকমার স্পর্শই কি লাগে তাঁর!
বাংলোর গেট পর্যন্ত অতিথিকে ছাড়তে এসেছেন পাঞ্চালি। গোধূলির অদ্ভুত সন্ধিক্ষণের মতোই এ-ও এক সন্ধিক্ষণ…কুড়ি কুড়ি বছরের পার আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা…ছাড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্তও গেরস্থের বাড়ি তো!
অমলতাসেরা বেড়ে উঠবে…গাছে আমলকি আসবে…সুঘ্রাণ ছড়াবে আম-কাঁঠাল…ফুলেরা আলো করবে বাগিচা। তিনি আসবেন কি আর ওদের দেখতে? ওদের সঙ্গে কথা বলতে?
রাজনীতির মালিন্য যাঁকে এত দিনেও গ্রাস করেনি, সেই তাঁর হাসিটা যেন মলিন লাগে! মুখ্যমন্ত্রীর বাংলোর গেটে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে থাকেন পাঞ্চালি…
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy