লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের ওপর দিয়ে ছুটল ট্রেন। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে পাওয়া।
রেল লাইনের উপর এবং পাশে দাঁড়িয়ে দশেরার রাবণ পোড়ানো দেখছিলেন কয়েকশ মানুষ। আর সেই ভিড়ের উপর দিয়েই দুরন্ত গতিতে চলে গেল ট্রেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা ঘটল পঞ্জাবের অমৃতসরের চৌরি বাজার এলাকায়।
প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে ৬০। আহত বহু। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন পুলিশ এবং উদ্ধারকারীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী রেল লাইনের পাশে দশেরার রাবণের কুশপুতুল পোড়ানো হচ্ছিল। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ পঞ্জাবের অমৃতসর এবং মানাওয়ালা স্টেশনের মাঝখানে ২৭ নম্বর রেলগেট লাগোয়া মাঠে তখন সবে শুরু হয়েছে দশেরার অনুষ্ঠান। একটু আগেই প্রধান অতিথি হিসেবে হাজির হয়েছিলেন স্থানীয় বিধায়ক নভজ্যোৎ কৌর। ক্রিকেটার তথা কংগ্রেস নেতা নভজ্যোৎ সিংহ সিধুর স্ত্রী। ভিড়টাও তাই হয়েছিল ভালই। মাঠ উপচে শ’পাঁচেক দর্শক জড়ো হয়েছিলেন রেললাইনে। সেখান থেকেই চলছিল মোবাইলে ছবি তোলা। কেউ কেউ ভিডিয়ো-কলও করছিলেন।
রেললাইনের পাশে সেই রাবণ পোড়ানো দেখতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বহু মানুষ। রাবণ পোড়ানোর সময়ে বাজির আগুন ছিটকে আসতে থাকে। দর্শকদের একাংশ সরে লাইনের উপর উঠে আসেন। আর সেই সময়তেই ওই লাইন ধরে চলে আসে দ্রুত গতির একটি ট্রেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, আপ এবং ডাউন দুই লাইনেই এক সঙ্গে ট্রেন চলে আসে। তাই কোনও দিকেই সরতে পারেননি দর্শকরা। ট্রেনের চাকার তলায় পিষে যায় একের পর এক মানুষের দেহ।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, বাজির আওয়াজে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ট্রেনের আওয়াজ। তাই কেউ শুনতে পাননি। তাঁদের অভিযোগ, রাবণ দাহ যারা করছিলেন সেই আয়োজকরা অন্তত মানুষকে সতর্ক করতে পারতেন।
দেখুন ভিডিয়ো
Amritsar train accident video pic.twitter.com/hb9Q3f9qL6
— Satinder pal singh (@SATINDER_13) October 19, 2018
উত্তর রেলের জনসংযোগ আধিকারিক বলেন,“ সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ দুর্ঘটনাটি ঘটে অমৃতসর এবং মানেওয়ালার মাঝখানে ২৭ নম্বর গেটের সামনে। একটি ডিএমএউ ট্রেন চলে যায় ভিড়ের উপর দিয়ে।”
দুর্ঘটনার পরই পুলিশের বিশাল বাহিনী উদ্ধার কাজে নেমে পড়েন। সাহায্য করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। উদ্ধারকারীদের একজন বলেন, “ট্রেনটির গতি যথেষ্ট বেশি ছিল। অনেক দেহ লাইন থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে ছিটকে গিয়েছে ট্রেনের ধাক্কায়।”
আরও পড়ুন: রেল না উদ্যোক্তা, অমৃতসরে কার অপদার্থতার বলি হলেন এত জন মানুষ
প্রথম দফায় অমৃতসর সিভিল হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজে আহতদের নিয়ে যাওয়া হয়। অমৃতসর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে ৫০ জনের। আরও অনেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালে মারা যান অনেকে। পুলিশের অনুমান মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে, কারণ এখনও উদ্ধার কাজ শেষ হয়নি।
আলোর অভাবে উদ্ধার কাজ প্রথম দিকে যথেষ্ট ব্যহত হয়। টর্চ এবং মোবাইলের আলোতে উদ্ধার কাজ চালাতে হয়। উদ্ধারকারীদের একজন বলেন, লাইনের পাশে প্রায় ১০০ মিটার জায়গা জুড়ে পড়ে ছিল ছিন্ন ভিন্ন মানুষের দেহ। দেহাংশ ছড়িয়ে রয়েছে লাইন জুড়ে।
আরও পড়ুন: পুজো বন্ধের হুমকি পুরোহিতের, শবরীমালায় মন্দিরের দরজা থেকে ফিরলেন দুই মহিলা
পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দার সিংহ শনিবার সকালেই ঘটনাস্থলে যাবেন। তিনি গোটা ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, “আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারের।” ইতিমধ্যেই মৃতদের পরিবার পিছু পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করেছে পঞ্জাব সরকার। ঘটনায় শোকপ্রকাশ করেছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী। শোকজ্ঞাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। মৃতদের পরিবার-পিছু ২ লক্ষ টাকা দেবে কেন্দ্র। আমেরিকার অনুষ্ঠান বাতিল করে দেশে ফিরছেন রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইট করে মৃতদের পরিবারকে সমবেদনা জানিয়েছেন এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন। অমরেন্দ্র সিংহ জানিয়েছেন, কাল তিনি ঘটনাস্থলে যাবেন।
তবে এলাকার মানুষ রেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। তাঁদের অভিযোগ,“ ট্রেনটি এত মানুষের ভিড় দেখেও গতি কমায়নি। হর্ণও দেয়নি দর্শকদের সতর্ক করতে।” গোটা ঘটনা ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে রাজ্য প্রশাসন এবং রেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবকে নিয়ে, যার জেরে প্রাণ গেল এত মানুষের। কী ভাবে অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ের পাশে এই অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হল? আর হলেও রেল কর্তৃপক্ষকে কী জানানো হয়েছিল?
ট্রেনে পিষ্ট দেহ উদ্ধারে পুলিশের পাশে স্থানীয় বাসিন্দারাও। শুক্রবার অমৃতসরে। ছবি এএফপি।
কয়েকটি প্রশ্ন অবশ্য উঠে গেল আজই। শুরু হয়ে গেল রাজনৈতিক তরজাও। রেললাইনের এত কাছে কেন রাবণপোড়ার অনুমতি দেওয়া হল, প্রশাসনের দিকে আঙুল তুলছেন একাংশ। সেই সূত্রে বিতর্কে নাম জড়াল সিধু-পত্নীর। অমৃতসরে চৌরাবাজারের জোড়া ফটকের ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনিই। এত মানুষের প্রাণহানির জন্য সরাসরি রেলকেই দুষছেন কৌর। তবে রেলের দাবি, তাদের কাছে এই অনুষ্ঠানের জন্য কেউ অনুমতি নেননি।
পুলিশ উদ্ধারকাজে ব্যস্ত। শুক্রবার অমৃতসরে। পিটিআই।
প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশ আবার এই দুর্ঘটনায় প্রহরাবিহীন রেল-ক্রসিংকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। তাঁদের দাবি, রাবণপোড়া শুরুর পরেই একটা বিস্ফোরণ হয়। ইতস্তত বাজি পড়তে শুরু করে। তার জেরেই ভিড়ের একটা অংশ লাইনে এসে পড়েন এবং হঠাৎ ট্রেন এসে পড়ায় তাঁরা দিশাহীন হয়ে যান। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীদেরই তোলা ভিডিয়ো বলছে, আগে থেকেই রেললাইনে দাঁড়িয়ে দশেরা দেখছিলেন শিশু-বৃদ্ধ মিলিয়ে প্রায় শ’পাঁচেক লোক। রেলেরও দাবি, ওই সময়ে রেলগেট বন্ধই ছিল। কিন্তু লাইনে এমন একটা জমায়েত দেখেও জালন্ধর-অমৃতসর ডিএমইউ কেন গতি নিয়ন্ত্রণ করল না, সে প্রশ্ন উঠছে। একাংশ বলছেন, ট্রেনের চালক হুটার বাজিয়েছিলেন, কিন্তু বাজির শব্দে তা টের পাননি লাইনে থাকা মানুষেরা।
মৃতদেহ নিয়ে চলছে প্রতিবাদ। ছবি: এপি
একাংশের অভিযোগ, দুর্ঘটনার খবর পেয়েই এলাকা ছে়ড়ে পালান নভজ্যোৎ কৌর সিধু। পরে কৌর যদিও সাংবাদিকদের জানান, অনুষ্ঠান সুষ্ঠু ভাবে মিটিয়ে বাড়ি ফেরার মিনিট পনেরো পরে তিনি ওই দুর্ঘটনার খবর পান এবং তড়িঘড়ি হাসপাতালে পৌঁছন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রতি বছরই তো ওখানে দশেরা হয়। প্রশাসন তৈরিই থাকে। এ বারেও ছিল। কিন্তু ট্রেন কেন এমন একটা সময়ে গতি কমাবে না! এত বড় একটা ট্র্যাজেডির দিনেও লোকে রাজনীতি করছে।’’
প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর কথায়, ‘‘এটা দুর্ঘটনা নয়। মারাত্মক অপরাধ। মানুষের জীবন নিয়ে খেলা। আজকের ঘটনার জেরে মানুষ দু’-চার দিন রেল অবরোধ করতেই পারেন। কিন্তু সেটা কোনও সমাধান নয়।’’
(কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাত থেকে মণিপুর - দেশের সব রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে আমাদের দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy