Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

গেরুয়া গুঁতোয় তড়িঘড়ি ময়দানে মরিয়া মায়া

তিলক, তরাজু অউর তলোয়ার, ইনকো মারো জুতা চার। ভুল! এ তো পুরনো স্লোগান! আমি না কি টিকিট বিক্রি করছি? ভুল ভুল! আমার দল না কি নড়বড়ে? নেতারা সব ছেড়ে চলে যাচ্ছেন?

মায়াবতীর জনসভায় সমর্থকদের উচ্ছ্বাস। —নিজস্ব চিত্র

মায়াবতীর জনসভায় সমর্থকদের উচ্ছ্বাস। —নিজস্ব চিত্র

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
আগরা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৬ ০৩:০৬
Share: Save:

তিলক, তরাজু অউর তলোয়ার, ইনকো মারো জুতা চার।

ভুল! এ তো পুরনো স্লোগান!

আমি না কি টিকিট বিক্রি করছি?

ভুল ভুল!

আমার দল না কি নড়বড়ে? নেতারা সব ছেড়ে চলে যাচ্ছেন?

ভুল ভুল ভুল!

দলই যদি নড়বড়ে, তা হলে টিকিট বিক্রি নিয়ে মারামারি কেন? আর একটা কথা মন দিয়ে শোনো, আকাশে থুতু ছেটালে আকাশ ময়লা হয় না, থুতু নিজের গায়েই এসে পড়ে।

ভরা মাঠে দাঁড়িয়ে এ সব কথা যিনি বলছেন, দলের লোকেরা বলে, তিনি নাকি দলিত শক্তির প্রতীক। তিনি নিজে বলেন, দলিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণি তাঁকে শুধু ‘বহেনজি’ ডাকে না, ‘দেবী’ বলেও মানে! সেই দেবীর জন্য এ দিন মঞ্চে একটি বিশাল কলেবরের সোফাকে সিংহাসন বানানো হয়েছিল। হাতের ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগটি রেখে সেই সিংহাসনে দু’হাত ছড়িয়ে তিনি বসলেন, দেবীর মতোই! বাকি নেতারা পিছনের ছোট ছোট চেয়ারে কোনও রকমে ঠেসেঠুসে বসে!

সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বক্তৃতা শুরু করলেন মায়াবতী। বহুজন সমাজ পার্টির সর্বময় নেত্রী। যে বক্তৃতার পরতে পরতে ভোটের প্রচার। উত্তরপ্রদেশ ভোটের এখনও কয়েক মাস বাকি। সেখানে এত আগে কখনও প্রচার শুরু করেননি ‘বহেনজি’ মায়াবতী। কিন্তু এ বারে রাজনৈতিক জীবনের সবথেকে কঠিন লড়াইয়ের মুখে তিনি। গত দু’বছরে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের গেরুয়া বাহিনীর হাতে অনেকটা জমি হারিয়েছেন মায়াবতী। সেই জমি উদ্ধারে তাই মরিয়া হয়ে অনেক আগেই তড়িঘড়ি নেমে পড়লেন ময়দানে। পঞ্চম বার লখনউয়ের সিংহাসনে বসার জন্য মায়াবতীর তুরুপের তাস করেছেন তাঁর বরাবরের দলিত ও সংখ্যালঘু ভোটকেই। সে কারণে প্রচারের দামামা বাজানোর জন্য প্রথম সভা করলেন তথাকথিত ‘দলিত রাজধানী’ আগরায়। যার চার পাশে বিস্তর সংখ্যালঘুরও বাস। কিছু দিন আগে এই আগরাতেই বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ দলিতদের জড়ো করতে না পারায় সভা বাতিল করেছিলেন। এ দিন সেটা মাথায় রেখে মাঠ উপচে না পড়া পর্যন্ত মায়াবতী বসে রইলেন লখনউয়ে। মঞ্চে এলেন দু’ঘণ্টা পরে। আসলে এই ভিড় আর উন্মাদনাই যে তাঁর মূলধন।

প্রচার নিয়ে এত তাড়না আগে কখনও দেখা যায়নি মায়ার। আসলে গত কয়েক মাসে সত্যিই তাঁর ভিত নড়ে গিয়েছে। বেশ কিছু বড় নেতা দল ছেড়েছেন। দলিত বাড়িতে ভোজ সেরে অমিত শাহ তাঁর কোর ভোটব্যাঙ্কেও চিড় ধরিয়েছেন কিছুটা। এক সময় উচ্চবর্ণকে গাল পেড়ে মায়াবতী যে স্লোগান দিতেন, সেটিও অমিত শাহ সুকৌশলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন গো-বলয়ের সবথেকে বড় রাজ্যে। এই পরিস্থিতিতে ‘বহেনজি’র জিয়নকাঠি বিজেপিরই নেতা দয়াশঙ্কর সিংহের তাঁর উদ্দেশে বলা কুকথা। যার পরে অবশ্য দয়াশঙ্করকে বিজেপি বহিষ্কার করেছে। দেশজুড়ে চলা একের পর এক দলিত-নিগ্রহের ঘটনাও তাঁর কাছে অক্সিজেন।

বিজেপির বিপদ মাথায় রেখেই তাই আজ প্রায় এক ঘণ্টার বক্তৃতার সিংহভাগ জুড়ে বিঁধলেন মোদী আর মোহন ভাগবতকে। দশ মিনিটের সাংবাদিক বৈঠক হোক বা এক ঘণ্টার জনসভা— বরাবর লিখেই আনেন নিজের বক্তৃতা। আজও তার অন্যথা হয়নি। সেই লিখিত বক্তৃতায় কংগ্রেসের উচ্চবর্ণের ভোট টানার ঝোঁক আর অখিলেশের আমলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে খোঁচা থাকলেও আগাগোড়া নিশানায় ছিল বিজেপি আর আরএসএস। সদ্য গতকাল এই আগরাতেই সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বলে গিয়েছিলেন, হিন্দুদের আরও বেশি সন্তান করতে আইনে বাধা কোথায়? আক্রমণের লক্ষ্য অবশ্যই সংখ্যালঘুরা।

মায়াবতীর হাতে যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা! যে দলিত ও সংখ্যালঘু ভোটে তিনি সওয়ার হতে চাইছেন, বিজেপি আর আরএসএস যেন সেই অস্ত্রই তাঁর হাতে তুলে দিচ্ছে একে একে! এই সুযোগে বিজেপি-আরএসএসকে নিশানা করে উত্তরপ্রদেশের লড়াইটা বিজেপি বনাম বহুজন সমাজ পার্টিতে নিয়ে যেতে চাইছেন মায়াবতী। বললেন, “আরএসএস প্রধান হিন্দুদের সন্তান বাড়াতে বলছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদী কি তাঁদের মুখে রুটি দিতে পারবেন? সংখ্যালঘু ও দলিতদের উপর অত্যাচার হচ্ছে। মোদীর নিজের রাজ্যেও তা হচ্ছে। মোদী আরএসএসেরই এজেন্ডা পালন করছেন।’’ একই সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘দলিত নিয়ে মোদীর সহানুভূতি চাই না। দু’বছরে কোনও প্রতিশ্রুতিও তো পালন করতে পারেননি মোদী। শুধু হিন্দু ভোটকে একজোট করার বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দলিত ভোট টানতে চাইছেন। আর সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে যোগসাজস করে হিন্দু ও মুসলমান ভোট ভাগাভাগি করতে চাইছেন।”

বিজেপি অবশ্য সব অভিযোগ উড়িয়ে জানিয়েছে, যোগসাজস রয়েছে মায়াবতী ও কংগ্রেসের। মায়াবতী দলিত ও সংখ্যালঘু ভোট চান, আর শীলা দীক্ষিতকে সামনে রেখে কংগ্রেস উচ্চবর্ণের। এক সময় ‘তিলক তরাজু…র স্লোগান দিয়ে উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন মায়াবতী। পরে স্লোগান বদলে বলেছিলেন, ‘হাতি নেহি গণেশ হ্যায়, ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ হ্যায়’। কিন্তু সেই রসায়ন ধরে রাখতে পারেননি। তাই নিজের কোর ভোটব্যাঙ্কেই ফের ফিরতে চাইছেন। আগামী এক মাসে রাজ্য জুড়ে ফি-হপ্তায় একটি করে সভা করবেন মায়াবতী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mayawati Election campaign
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE