উপরের ধুলো সাফ হবে। কিন্তু অর্থনীতির ভিতরের ময়লা থেকেই যাবে। এবং নতুন ময়লাও জমতে থাকবে আবার।
পুরনো ৫০০, ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে দেওয়াকে কালো টাকার উপর ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ নয়, নিছক ‘স্বচ্ছতা অভিযান’-এর বেশি কিছু বলতে নারাজ কালো টাকা নিয়ে গবেষণারত অর্থনীতিবিদরা। তাঁদের যুক্তি, নরেন্দ্র মোদীর এই সিদ্ধান্তে নগদে জমিয়ে রাখা কালো টাকা সাফ হবে ঠিকই। কিন্তু তা কালো আয়ের খুবই সামান্য অংশ। তা ছাড়া, নতুন করে কালো টাকা বা বেআইনি সম্পত্তি জমিয়ে তোলার পদ্ধতিও শীঘ্রই বেরিয়ে পড়বে।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি অবশ্য আজ দাবি করেছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তে সমান্তরাল কালো অর্থনীতিতে জোরালো ধাক্কা লাগবে। মোদী সরকার মনে করছে, যাঁরা কর ফাঁকি দেওয়া আয় ৫০০, ১০০০ টাকার নোটে জমিয়ে রেখেছেন, তাঁদের এ বার ব্যাঙ্কে এসে তা জমা দিতে হবে। বিরাট পরিমাণ অর্থ জমা দিতে গেলে বা বদলে নিতে গেলেই আয়কর দফতরের নজরদারিতে পড়ে যাবেন তাঁরা। কেন্দ্রীয় রাজস্বসচিব হাসমুখ আঢিয়া এ দিন জানান, দেড়-দু’লক্ষ টাকা অর্থমূল্যের পুরনো নোট যাঁরা ব্যাঙ্কে জমা করবেন, তাঁদের চিন্তার কোনও কারণ নেই। কিন্তু জমা করা পুরনো নোটের অর্থমূল্য দু’লক্ষ টাকা পেরিয়ে গেলেই তা নিয়ে অর্থ দফতর প্রশ্ন তুলতে পারে। তাঁর কথায়, ‘‘আড়াই লক্ষের বেশি নগদ জমার উপরে নজর রাখা হবে। আয়কর রিটার্নের সঙ্গে খতিয়ে দেখে যদি আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন নগদ ধরা পড়ে তখন তাঁকে প্রযোজ্য কর এবং তার উপর ২০০ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে।’’ কেউ এখন কালো টাকা দিয়ে গয়না কেনার চেষ্টা করলে কী হবে? রাজস্বসচিবের বক্তব্য, গয়না কিনলে প্যান জানাতে হবে। ফলে তিনি নজরদারির আওতায় থাকবেন। আর প্যান ছাড়া গয়না বিক্রি করলে অলঙ্কার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু অর্থনীতিবিদদের যুক্তি, কর ফাঁকি দেওয়া আয়ের খুব সামান্য অংশই লোকে নগদে জমিয়ে রাখে। বেশির ভাগটাই খরচ করে ফ্ল্যাট-জমি, দামি জিনিসপত্র বা সোনার গয়না কিনে। অনেকেই আবার বেআইনি আয়ের একটা অংশ কর ফাঁকির স্বর্গরাজ্য বলে পরিচিত দেশগুলিতে পাঠিয়ে দেন। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৌমেন চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘কালো টাকা ও কালো অর্থনীতির মধ্যে ফারাক রয়েছে। চাকুরিজীবীদের কর ফাঁকি
দেওয়ার সুযোগ খুব একটা থাকে না। ব্যবসায়ী, ডাক্তার, উকিলের মতো পেশাদারদের কর ফাঁকি দিয়ে পাওয়া আয়ের উপরেই কালো অর্থনীতি গড়ে ওঠে। লাভের অঙ্ক কম দেখিয়ে অনেক ব্যবসায়ী বা শিল্প সংস্থা কর ফাঁকি দেয়। কিন্তু সেই বেআইনি আয়ের খুব সামান্য অংশই নগদে ধরা থাকে। এত দিন ধরে যে বেআইনি আয় হয়েছে, তার সিংহভাগই জমি-বাড়ি, গয়না কিনে খরচ হয়ে গিয়েছে।’’
কালো টাকা নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করা অরুণ কুমার লিখেছিলেন, ‘মোটামুটি ভাবে বলা যায়, ১০০ টাকা বেআইনি আয় হলে ৫০ টাকাই খরচ করে ফেলা হয়। বাকিটা জমে। তার মধ্যে ১০ টাকা চলে যায় কর ফাঁকির স্বর্গরাজ্যে। সেখানে ভুঁইফোঁড় সংস্থা গড়ে ওঠে। ওই সব সংস্থাই আবার এ দেশে লগ্নি করে। সেখান থেকে কালো টাকার মালিকরা আয় করেন।’
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের ফলে নতুন করে কালো টাকা তৈরিও বন্ধ হবে না। কারণ পুরনো ৫০০ টাকার নোট বাতিল হলেও এক দিন পরেই নতুন ৫০০ টাকার নোট এসে যাবে। তার পর আসবে ২০০০ টাকার নোট। ডাক্তার, উকিলের মতো যে সব পেশাদাররা নগদে ফি নেন, তাঁরা নগদেই আয় করতে শুরু করবেন। কর ফাঁকিও চলবে।
২০১০-এ বিশ্বব্যাঙ্ক জানায়, ১৯৯৯ সালে ভারতে কালো অর্থনীতির বহর ছিল জিডিপি-র ২০.৭ শতাংশ। ২০০৭-এ যা ২৩.২ শতাংশে গিয়ে পৌঁছয়। এখন এর পরিমাণ কত, সে সম্পর্কে সরকারেরও স্পষ্ট ধারণা নেই। অনেকেই মনে করেন, এই হার এখন ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ অন্তত ৩০ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, এই বেআইনি কাজকারবারের ফলে দেশের অর্থনীতির বহর নিজস্ব ক্ষমতা অনুযায়ী বাড়তে পারছে না। আর্থিক বৃদ্ধির হারও হোঁচট খাচ্ছে। বাজারে যাঁরা কালো টাকার ঝুলি হাতে যাচ্ছেন, তাঁরা যেমন খুশি খরচ করছেন। ফলে মূল্যবৃদ্ধি বাড়ছে। ফ্ল্যাট-জমির দাম কম দেখিয়ে নগদে লেনদেন হওয়ায় রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে। তাই এই সিদ্ধান্ত।
কিন্তু কংগ্রেস-সহ সব বিরোধী দলই মনে করছে এর ফল লাভের থেকে সাধারণ মানুষের ভোগান্তিই বেশি হবে। কারণ দেশের ৮০ শতাংশ কেনাবেচাই নগদে হয়। জেটলির অবশ্য যুক্তি, ‘‘কিছু দিনের জন্য ভোগান্তি হবে বলে কালো টাকা রুখতে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হবে না, এটা কোনও যুক্তি নয়।’’
সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ ভিরমানি, সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের রাজীব কুমারের মতো অর্থনীতিবিদরা যুক্তি দিয়েছেন, শুধু কালো টাকা আটক নয়, এই কালো টাকা জমা দিতে গিয়েই অনেকে আয়কর দফতরের নজরে পড়ে যাবেন। বিশেষ করে আবাসন ক্ষেত্রে কালো টাকার লেনদেন বন্ধ হবে। কিন্তু পাল্টা যুক্তি হল, কর ফাঁকি দেওয়ার নতুন নতুন রাস্তাও বেরিয়ে পড়বে।
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম আজ বলেছেন, ১৯৭৮-এ মোরারজি দেশাই সরকার ১০০০, ৫০০০ ও ১০,০০০ টাকার নোট বাতিল করেছিল। তাতে কালো অর্থনীতি বন্ধ হয়নি। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কালো টাকা তৈরি হওয়া বন্ধ করা উদ্দেশ্য হলে, ১০০০-এর বদলে ২০০০ টাকার নোট চালু হচ্ছে কেন?’’ কিন্তু জেটলির যুক্তি, ওই সময় এত বড় অঙ্কের নোটের সংখ্যা খুবই কম ছিল। বাজারে মোট নোটের ১০ শতাংশেরও কম। কিন্তু এখন ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাজারের ৮৬ শতাংশ জুড়ে রয়েছে। ফলে এর ধাক্কাও বেশি লাগবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy