Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

জঙ্গিদের জমি ছাড়তে নারাজ মুরমু-র ঠাকুররা

সিনেমার পর্দার রামগড়ের সঙ্গে বেশি ফারাক নেই লাতেহারের মুরমু-র। পাহাড়ঘেরা, রুক্ষ সেই গ্রামের জমিদার ঠাকুর পরিবার। খেতখামারে ব্যস্ত থাকেন গ্রামবাসীরা। অনেকটা যেন সত্তরের দশকের ‘ব্লকবাস্টার’ শোলে-র চিত্রনাট্য। ডাকাত-সর্দার গব্বর সিংহের মতো আতঙ্ক ছড়াতে মুরমুতে মাঝেমধ্যে দলবল নিয়ে হানা দেয় মাওবাদী জঙ্গি নকুল যাদব।

মুরমু গ্রামের সেই ঠাকুর বাড়ি। — নিজস্ব চিত্র।

মুরমু গ্রামের সেই ঠাকুর বাড়ি। — নিজস্ব চিত্র।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়
লাতেহার শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৯
Share: Save:

সিনেমার পর্দার রামগড়ের সঙ্গে বেশি ফারাক নেই লাতেহারের মুরমু-র।

পাহাড়ঘেরা, রুক্ষ সেই গ্রামের জমিদার ঠাকুর পরিবার। খেতখামারে ব্যস্ত থাকেন গ্রামবাসীরা। অনেকটা যেন সত্তরের দশকের ‘ব্লকবাস্টার’ শোলে-র চিত্রনাট্য। ডাকাত-সর্দার গব্বর সিংহের মতো আতঙ্ক ছড়াতে মুরমুতে মাঝেমধ্যে দলবল নিয়ে হানা দেয় মাওবাদী জঙ্গি নকুল যাদব।

কয়েক দিন আগে ‘শত্রু’ ঠাকুর পরিবারের তিন জনকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় জঙ্গিরা। তা নিয়ে তোলপাড় গোটা ঝাড়খণ্ড। নকুলের মাথার দাম ১০ লক্ষ টাকা ঘোষণা করে রাজ্য সরকার।

মাও-হানার পর কেমন আছে মুরমু? তা জানতেই সফর লাতেহারে। স্টেশন থেকে সরযূ যাওয়ার রাস্তায় কিলোমিটার খানেক এগোতেই বাঁ দিকে সুরকি ঢালা সড়ক বেঁকেছে প্রত্যন্ত মুরমুর দিকে। রাঁচি থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরের ওই গ্রামে তখন সূর্য প্রায় মাথার উপরে। সেটা যে মাওবাদীদের দুর্গ, তা সহজেই টের পাওয়া যায়। পাহাড়, জঙ্গলে ঘেরা মুরমু, সাঙ্গোটিয়া, কেলহারি, আমুয়াটিকার রাস্তাঘাট নির্জন, শুনশান, থমথমে। দু’সপ্তাহ আগের হামলার রেশ তখনও টাটকা। যে দিন মাওবাদী নকুলের দলবল একের পর এক খুন করেছিল ঠাকুর লাল বালকিশোরনাথ সহদেব, তাঁর ছেলে ঠাকুর লাল প্রমোদনাথ সহদেব, বাল কিশোরের ভাই ঠাকুর লাল জয়কিশোর নাথ সহদেবকে।

অচেনা লোক দেখে ভিড় জমল। কেউ কেউ জানালেন, রাজপুত ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে অনেক বছরের শত্রুতা মাওবাদীদের। স্বাধীনতার আগে রাঁচির রাতু মহারাজার পরিবারের কয়েক জন মুরমুতে চলে এসেছিলেন। কয়েক’শো একর জমি ছিল তাঁদের। সেখানে চাষ করতেন মুরমুর বাসিন্দারা। আশির দশকে মাওবাদীরা গ্রামের কয়েক জনকে দলে টেনে নেয়। সামন্ততন্ত্র দূর করার কথা বলে মুরমু থেকে ঠাকুর পরিবারকে উৎখাত করার চেষ্টা শুরু হয়। গ্রামের অনেকেই গিয়েছিল মাওবাদী শিবিরে। কিন্তু নিজেদের ভুল বুঝতে পারে কিছু দিনেই। গ্রামবাসীদের ফসল, ভাঁড়ারে ভাগ বসাতে থাকে জঙ্গিরা। এতেই গ্রামবাসীদের সঙ্গে মাওবাদীদের দুরত্ব তৈরি হয়। দল ছেড়ে দেওয়া লোকেদের উপর অত্যাচার শুরু করে জঙ্গিরা। খুন, অপহরণ চলতে থাকে। ওই সময় তাঁদের পাশে দাঁড়ায় ঠাকুর পরিবার।

মুরমুর জমিদার পরিবারের ঠাকুর বাল মুকুন্দনাথ সহদেব বলেন, ‘‘মাওবাদীরা আমাদের সামন্তপ্রভু বলে। কিন্তু জমিদারির কিছুই বাকি নেই। যেটুকু রয়েছে, সেখানে গরিব গ্রামবাসীরা চাষাবাদ করে। এটা নৈতিক লড়াই নয়। ঠাকুর পরিবারকে তাড়াতেই ওরা এ সব করছে।’’

পেশরার পাহাড়ের কোলে ঠাকুর পরিবারের পুরনো আমলের জমিদার বাড়ি। সঞ্জীবকুমার-অমিতাভ-ধর্মেন্দ্র-আমজাদের রূপোলি পর্দার ওই ছবির মতোই। পাহাড়ের উপর দিয়ে যেন যে কোনও সময় নেমে আসবে সশস্ত্র হানাদাররা। জঙ্গিদের রুখতে নিরাপত্তার বজ্রআটুনি ঠাকুরবাড়িতে। পরপর তিনটি লোহার দরজা পেরিয়ে ঢুকতে হয় সে বাড়ির অন্দরমহলে। পাহারায় মোতায়েন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা।

পরিবারের কয়েক জন জানালেন, মাওবাদীদের তাঁরা ভয় পান না। আগেও হামলা হয়েছে ঠাকুর পরিবারে। ৯০-এর দশকে এক বার একই রকম হামলা হয়েছিল। তবে বরাতজোরে সকলেই বেঁচে যান। এরপরই রাজ্য ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের জন্য ৪০টি বন্দুকের লাইসেন্স দেয়। নিজেদের নিরাপত্তায় বন্দুক চালাতে জানেন ঠাকুর বাড়ির মহিলারাও। ওই মহলে রয়েছে ৮টি জিপ। বের হলে বন্দুক নিতে ভোলেন না সে বাড়ির কেউ-ই।

সূর্য কিছুটা হেলেছে পাহাড়ের দিকে। লালচে রঙ ধরেছে তাতে। সে দিকে তাকিয়ে ঠাকুর লাল রঞ্জিতনাথ সহদেব বললেন, ‘‘জমির বেশিরভাগটাই মাওবাদীরা দখল করেছে। আমাদের বন্দুকের গুলি এখন যতটা দূরে পৌঁছয়, ততটাই সম্পত্তি রাখতে পেরেছি। আতঙ্ক রয়েছে। কিন্তু আমরা হারতে রাজি নই।’’ ঝাড়খণ্ডের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বাল মুকুন্দনাথের মন্তব্য, ‘‘পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি বাঁচাতে প্রাণপণে লড়ব। জঙ্গিরা চায় আমরা সব কিছু ফেলে চলে যাই। কিন্তু ঠাকুর পরিবার পালাতে শেখেনি।’’

হয়তো সত্যিই বলছেন মুরমুর ঠাকুররা। সিনেমার পর্দাতেও তো বলা হয়েছিল— ‘ঠাকুর না ঝুক সকতা হ্যায়। না টুট সকতা হ্যায়। ঠাকুর সির্ফ মর সকতা হ্যায়।’’

সেই কাহিনির শেষটা তো সবারই জানা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE