Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
মত বদল কোর্টেরও

গুরু অপরাধে নাবালকের কড়া শাস্তির প্রস্তাব

আইন পাল্টাতে সলতে পাকানোর কাজ চলছিলই। সুপ্রিম কোর্ট অবস্থান বদলের পর খুন-ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধে নাবালকদেরও কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করতে ‌আরও উদ্যোগী হল নরেন্দ্র মোদীর সরকার। সুপ্রিম কোর্ট কাল কেন্দ্রীয় সরকারকে নাবালক বিচার আইন খতিয়ে দেখে এই আইনকে আরও কঠোর করার কথা বলেছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪০
Share: Save:

আইন পাল্টাতে সলতে পাকানোর কাজ চলছিলই। সুপ্রিম কোর্ট অবস্থান বদলের পর খুন-ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধে নাবালকদেরও কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করতে ‌আরও উদ্যোগী হল নরেন্দ্র মোদীর সরকার।

সুপ্রিম কোর্ট কাল কেন্দ্রীয় সরকারকে নাবালক বিচার আইন খতিয়ে দেখে এই আইনকে আরও কঠোর করার কথা বলেছে। শীর্ষ আদালতের মতে, খুন বা ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে নাবালকদের আরও কঠিন শাস্তির প্রয়োজন।

শীর্ষ আদালত এই কথা বলার আগেই অবশ্য নাবালক বিচার আইনে সংশোধন নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। মেনকা গাঁধীর নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক এ বিষয়ে বিল তৈরির কাজও সেরে ফেলেছে। সরকারি সূত্রের খবর, খুব শীঘ্রই মেনকা গাঁধীর মন্ত্রকের তৈরি বিল নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় আলোচনা হবে।

বর্তমান আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের কমবয়সি কোনও অপরাধীর বিচার আদালতে হয় না। নাবালকদের বিচার হয় পৃথক বোর্ডে। খুন বা ধর্ষণ, যত বড় অপরাধই হোক না কেন, তাতে ফাঁসি তো দূরের কথা, কারাদণ্ডও হয় না। সর্বাধিক শাস্তি তিন বছর নাবালকদের শোধনাগারে কাটানো। এমনকী, নিম্ন আদালতে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার পরেও কেউ উচ্চ আদালতে গিয়ে দাবি করতে পারে, ঘটনার সময় সে নাবালক ছিল।

মেনকার মন্ত্রক ঠিক কী কী বদল চাইছে এই আইনে? নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক বিলের যে খসড়া তৈরি করেছে তার মূল প্রস্তাবগুলি এ রকম:

• অভিযুক্ত নাবালক হলেও তাকে প্রাপ্তবয়স্ক ধরে নিয়ে বিচার হতে পারে।

• অভিযুক্তের অপরাধের মাত্রা দেখে এই সিদ্ধান্ত হবে।

• নাবালক বিচার বোর্ড বা জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডই ঠিক করবে, অভিযুক্তকে নাবালক নাকি প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে হিসেবে গণ্য করা হবে।

• অপরাধ প্রমাণ হলে, ফাঁসি বা যাবজ্জীবন না হলেও কারাদণ্ড হতে পারে। এই খসড়া বিল নিয়ে এ বার আলোচনা হবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে।

সাম্প্রতিক কালে এই আইন বদলের দাবি নিয়ে দেশ জুড়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল নির্ভয়া কাণ্ডের পরপর। নির্ভয়ার ধর্ষক ও খুনিদের মধ্যে এক জন নাবালক হওয়ায় কড়া শাস্তির হাত থেকে সে রেহাই পেয়ে যায়। পরে মুম্বইয়ের শক্তি মিলসে ধর্ষণের ঘটনাতেও নাবালক বলে অপরাধীদের রেহাই পেতে দেখা গিয়েছে। প্রশ্ন ওঠে, নাবালক বলেই গুরু অপরাধে লঘু শাস্তি দেওয়াটা আদৌ সঙ্গত কিনা। সমাজকর্মীদের একাংশ দাবি করেন, কোনও নাবালক পরিণতির কথা না ভেবেই খুন-ধর্ষণ করছে, এটা ধরে নেওয়া যায় না।

এ নিয়ে তীব্র বিতর্কের মধ্যেই এই আইন সংশোধনের জন্য ইউপিএ সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু নাবালকদের জন্য আইন বদলের সুপারিশ করেনি ওই কমিটি। এর পর জল গড়ায় সুপ্রিম কোর্টে। আবেদন জানানো হয়, ১৮ বছরের কমবয়সি অভিযুক্তরা যে আইনি সুরক্ষা পেয়ে থাকে, তা সরিয়ে নেওয়া হোক। খুন-ধর্ষণের মতো অপরাধে নাবালকদের বিচারও হোক আদালতেই। এবং শীর্ষ আদালত কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিক এ বিষয়ে। কিন্তু আদালত সেই আবেদন খারিজ করে দিয়ে বলে, আইন সংশোধন সংসদের এক্তিয়ার। কিন্তু শীর্ষ আদালতই এ বার আইন বদলের পরামর্শ দেওয়ায় এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে মোদী সরকার।

কী সূত্রে কাল আইন বদলের পক্ষে মত জানিয়েছে শীর্ষ আদালত?

হরিয়ানার এক খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত এক ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিল, ২০০০ সালে পাওনা টাকা না মেলায় এক ব্যক্তিকে সে খুন করে। ওই ঘটনার সময় তার বয়স ছিল ১৭ বছর ৯ মাস। দাবি প্রমাণ করতে মাধ্যমিক পাশের সার্টিফিকেট পেশ করে ওই ব্যক্তির আবেদন, নাবালক বিচার আইনে তার বিচার হোক। গত কাল সেই মামলাতেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি দীপক মিশ্র মন্তব্য করেন, ‘‘এটা কি কল্পনাও করা যায় যে আবেদনকারী ফল কী হবে না বুঝেই এই কাজ করেছে? অপরিণত মন থেকেই কি এই অপরাধ করা হয়েছে?’’

এনসিআরবি (ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো)-র খতিয়ান বলছে, নাবালকদের অপরাধের সংখ্যা গত এক দশকে ৭৮% বেড়ে গিয়েছে। ধর্ষণের হার বেড়েছে ৩০০%। এই পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য উপযুক্ত আইনের বিষয়ে চিন্তাভাবনার সময় এসে গিয়েছে বলে মত জানিয়েছে বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ। বেঞ্চের বক্তব্য, আক্রান্তের জীবনও যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, সেই বার্তা দেওয়াটা খুব জরুরি।

অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগিকে বেঞ্চ কাল জানিয়েছে, অন্তত গুরুতর অপরাধের শাস্তির সঙ্গে জড়িত আইনের দিকগুলি ফের খতিয়ে দেখা হোক। নতুন করে পর্যালোচনা হোক। বেঞ্চের যুক্তি, কোনও নাবালক যখন খুন-ধর্ষণ-ডাকাতির মতো অপরাধ করছে, তখন সে তার শাস্তি কী হতে পারে তা না ভেবেই করছে, এটা ধরে নেওয়া খুব কঠিন। এই বিষয়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য জানতে চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। রোহতগি জানান, তিনি সরকারের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে আদালতে হলফনামা জমা দেবেন।

সমাজকর্মীদের একটি অংশ কিন্তু যুক্তি দিচ্ছে, একটি-দু’টি মামলায় নাবালকরা জড়িত বলেই আইন বদলে ফেলা উচিত নয়। তাতে কিশোরদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়। এই পদক্ষেপ সংবিধান এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের শিশু-অধিকার সংক্রান্ত সনদেরও বিরোধী। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও আলোচনার পর এর বিরুদ্ধেই রায় দিয়েছে অতীতে।

আইন বদলের পক্ষে নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রকের বড় যুক্তি সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান। মন্ত্রক জানিয়েছে, নাবালকদের হাতে খুনের ঘটনা ২০০২ সালে ঘটেছিল ৫৩১টি। ২০১৩-তে তা বেড়ে হয় ১০০৭টি। একই সময়কালে ধর্ষণ বেড়েছে অনেক গুণ বেশি। ২০১২-তে নাবালকদের হাতে ধর্ষণের ৪৮৫টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছিল। ২০১৩-তে সেটা বেড়ে হয় ১৮৮৪। এই পরিস্থিতিতে নারী অধিকার আন্দোলনকারীরা কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রকের প্রস্তাবগুলিকে তাঁদের আন্দোলনের জয় হিসেবেই দেখছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE