সাতসকালেই ফোন করেছিলেন বিবেক। বিহারের বিজেপি নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী সি পি ঠাকুরের ছেলে। নিজেও পটনায় বিজেপির ডাকসাইটে যুব নেতা। ফোনের ও প্রান্তে গলাটা প্রায় কাঁদো কাঁদো।
“দাদা সব চ্যানেলের সব বুথ ফেরত সমীক্ষা তো আমাদের ঝাড়ু মেরে সাফ করে দিল! এখন কী হবে? সকালে সব খবরের কাগজ দেখে তো খুব হতাশ হয়ে গেলাম!” বললাম, “তোমাদের শীর্ষ নেতারা তো এখনও এই বুথ ফেরত সমীক্ষা বিশ্বাসই করছেন না! অমিত শাহ বলছেন, বিজেপি ‘ম্যাজিক নম্বর’ পাবেই। পঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে বুথ ফেরত সমীক্ষার ফলাফল ভুল হয়েছিল। এ বার দিল্লিতেও তাই হবে।” হতাশ বিবেক তাতেও চাঙ্গা না হয়ে বললেন, “সব চ্যানেল কি ভুল দেখাবে?” বললাম, “১০ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ভোটের ফলাফলেই জানা যাবে।”
মঙ্গলবারের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, দিল্লি ভোটের ফল বেরনোর আগেই বিজেপির বিক্ষুব্ধ নেতারা ঈষৎ নড়াচড়া শুরু করে দিয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা বিলক্ষণ জানেন যে, বৈশ্য নেতা বিজয় গোয়েল থেকে ব্রাহ্মণ নেতা সতীশ উপাধ্যায় বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হর্ষবর্ধন দিল্লির বিজেপি নেতারা সকলেই দলকে হারাতে রীতিমতো ধনুক ভাঙা পণ করেছিলেন! এঁরা সকলেই মনে করেন যে, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য তিনিই যোগ্য এবং শ্রেষ্ঠ প্রার্থী! এবং প্রবল অন্তর্কলহের এই বিষয়টি বুঝেই কিরণ বেদীকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করতে এক রকম বাধ্য হয়েছিলেন মোদী-অমিত শাহ। তাঁরা নিজেরাও জানতেন যে, তাঁরা বড় ঝুঁকি নিচ্ছেন। এ ব্যাপারে মোদী-অমিতের কৌশল ছিল দ্বিমুখী। এক দিকে দলের মূল স্রোতের কাউকে না বেছে এক সময়ের আপ-ঘনিষ্ঠ কিরণ বেদীকে প্রার্থী করে কেজরীবালের পথে কাঁটা বিছোনো, অন্য দিকে সরাসরি দলের ঘাড়ে দায় না নেওয়া। তাঁদের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ভবিষ্যতে দলে প্রশ্ন উঠতে পারে বুঝেই অমিত শাহ দলের সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকের ঠিক আগে আরএসএস নেতা রামলালকে পাঠিয়ে দেন লালকৃষ্ণ আডবাণীর বাড়ি। তাঁর সম্মতি নিয়ে রাখতে।
বিজেপির একটি সূত্র বলছে, দিল্লির বুথ ফেরত সমীক্ষার ফল দেখে দলের সর্বভারতীয় স্তরে আডবাণী, সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিংহ, মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিংহ চৌহানরা বেশ খুশি। দিল্লিতে হারলে এই নেতারা মোদী-অমিত শাহকে আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনাও শুরু করে দিয়েছেন। আডবাণী তো নিজেই আজ সুষমা ও হর্ষবর্ধনকে ফোন করে ডেকে পাঠিয়ে জানতে চেয়েছেন, কেন এমন হল?
বিজেপির সংসদীয় বোর্ড থেকে মোদী-অমিত শাহরা তাঁকে বাদ দেওয়ার পরে আডবাণী একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে দিল্লির ভোটে একটি জনসভা করার জন্যও দলের তরফে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি! এত দিন পরে তিনি হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠলেও বিজেপি সূত্র বলছে, দলে মোদী-অমিত শাহের নিয়ন্ত্রণ এখনও ষোলো আনার উপর আঠারো আনা। বিরোধীরা যতই সরব হন না কেন, মোদী অমিতের নেতৃত্ব নিয়ে এখনই ট্যাঁ ফোঁ করতে পারবেন না।
চূড়ান্ত ফল এখনও বেরোয়নি ঠিকই, কিন্তু হারের প্রস্তুতি যেন নিয়ে রেখেছেন বিজেপির একাধিক নেতা। তাঁদের নানা আলোচনায় যে সব বিষয় উঠে আসছে সেগুলি হল, প্রথমত লোকসভা ভোটের পরপরই দিল্লির ভোটপর্ব বা সেখানে সরকার গড়ে ফেলা উচিত ছিল। ফেলে রাখলে দলের পুনরুজ্জীবন হবে, এই তত্ত্ব ঠিক ছিল না। দ্বিতীয়ত কিরণ বেদী পুলিশ ব্যক্তিত্ব। তাঁকে বিজেপি কর্মীরা মন থেকে গ্রহণ করেননি। তা ছাড়া, দিল্লিতে বৈশ্য ভোট খুব শক্তিশালী। তাকে অবজ্ঞা করা বিজেপি নেতাদের উচিত হয়নি। তৃতীয়ত অমিত শাহের নেতৃত্বের সঙ্গে দিল্লির গরিব মানুষ নিজেদের একাত্ম করতে পারেননি। চতুর্থত গত কয়েক মাসে দিল্লির একাধিক চার্চে হামলা, ত্রিলোকপুরী-সহ নানা এলাকায় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনা বিজেপিকে বিপদে ফেলেছে। যুব সমাজের একটি বড় অংশই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নে আপকে ভোট দিয়েছে।
এর পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিষয় উঁকি দিচ্ছে। যেমন, গত নির্বাচনে কেজরীবাল সংবাদমাধ্যমের একাংশকে তোপ দাগলেও এ বারে তা করেননি। তা ছাড়া, মোদী যে ভাবে একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে নিজেও কেজরীবাল-বিরোধী প্রচারে নেমে পড়েছিলেন, তাতে অন্য রকম বার্তা গিয়েছে ভোটারদের কাছে। পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপনও আম-ভোটাররা ভাল ভাবে নেয়নি। আডবাণী, সুষমা-সহ অনেকেরই ধারণা, মোদীর উচিত ছিল কেজরীবালের বদলে কংগ্রেসকেই মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরে প্রচার চালানো। তাতে কংগ্রেস কিঞ্চিৎ অক্সিজেন পেলে ভোট ভাগাভাগির সুবিধে পেত বিজেপি। কিন্তু কেজরীবালকেই নিশানা করায় আখেরে লাভ হয়েছে আপ-এর। যেমন পশ্চিমবঙ্গে মমতার নিশানা হয়ে আখেরে তাঁদেরই লাভ হয়েছে বলে মনে করেন বিজেপি নেতৃত্ব।
বিজেপির বিক্ষুব্ধ নেতারা রবিবার সারা দিন ধরে ফোনে ফোনে এ সব নিয়ে নানা কথা বললেও মোদী-অমিত-অরুণ জেটলিদের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে এখনও সক্ষম নন। তবে অনেকেই বলছেন, আসলে এটাই ভারতীয় গণতন্ত্র। অতীতে শীলা দীক্ষিত যখন মুখ্যমন্ত্রী হন, তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। নরসিংহ রাও অন্ধ্রপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে হেরে গিয়েছিলেন। কংগ্রেস জমানায় বিজেপি বহু রাজ্যে ক্ষমতা দখল করেছে। বিজেপি জমানাতেও কংগ্রেস জয় পেয়েছে একাধিক রাজ্যে। কেন্দ্র-রাজ্য ভিন্ন রাজনীতির এই গণতন্ত্র ভারত দেখছে ১৯৬৭ সাল থেকেই। কিন্তু এ বারে প্রশ্নটা অন্য। তবে কি ন’মাস অতিবাহিত হতে না হতেই মোদী-ঝড় অবলুপ্ত? বিজেপি নেতারা আড়ালে বলছেন, ঝড় তো ঝড়ই! তা স্থায়ী হতে পারে না।
কিন্তু দিল্লির ফলের ধাক্কা কি লাগবে এ বছর নভেম্বরে বিহার এবং ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের ভোটে? বাজেট অধিবেশনে বিরোধীরা কি আরও আক্রমণাত্মক হবেন? জেটলির পক্ষে সংস্কার নিয়ে এগোনো কি কঠিন হয়ে যাবে? এই অবস্থায় মোদী-অমিতও খুঁজছেন ভবিষ্যতের পথ নির্দেশিকা। তবে এখনও তাঁদের অপেক্ষা ১০ তারিখ ভোটের আনুষ্ঠানিক ফলাফল প্রকাশের।
নাটকের শেষ অঙ্কে কোনও অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স কি অপেক্ষা করছে?
নাকি আশার ছলনা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy