জঙ্গি ঘাঁটি নিকেশ হল মায়ানমারের জঙ্গলে। জাতীয়তাবাদের আবেগে ভর করে বিজেপি এখন তার কৃতিত্ব নিতে শুরু করেছে। তবে চরম বিপাকে সনিয়া গাঁধীর দল। সন্ত্রাসবাদ আটকাতে মোদী সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চেয়েও জনভাবনার কথা ভেবে আপাতত মুখে তালা লাগিয়েছে তারা। মায়ানমারের ঘটনায় যেন ফুটে উঠেছে কার্গিলেরই ছায়া। এই রকম প্যাঁচে পড়ে সে দিনও অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারকে সমর্থন করতে হয়েছিল তাদের। আর আজ কংগ্রেস মোদীকে কৃতিত্ব না দিলেও সেনাবাহিনীর অভিযানের প্রশংসা করেছে।
মাত্র পাঁচ দিন আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কনভয়ে অতর্কিতে হামলা চালিয়েছিল উত্তর-পূর্বের খাপলাং ও নাগা জঙ্গিরা। তাতে নিহত হয়েছিলেন ১৮ জন সেনা জওয়ান। গত কাল মণিপুর ও নাগাল্যান্ড ঘেঁষা মায়ানমারের সীমান্তে ঢুকে পড়ে সেই জঙ্গিদের শিবিরে সফল অভিযান চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারা কম্যান্ডোরা। জঙ্গিরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের খতম করে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমানায় ঢুকে পড়ে এ ভাবে জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংসের ঘটনাকে যখন ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতির দম’ বলে তুলে ধরতে শুরু করেছে শাসক দল, তখন ফের দ্বিধার গর্তে ঢুকে পড়েছে কংগ্রেস! গোটা অভিযানের প্রশংসা না করেও উপায় নেই। আবার সরকারের প্রশংসা করলে তাঁদের রাজনীতির কী হবে!
মায়ানমারের সেনা অভিযানের প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজ্যবর্ধন সিংহ রাঠৌর আজ বলেন, ‘‘হট পারস্যুটের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেনাবাহিনীর ওপর জঙ্গি হানার পরেই তিনি স্পষ্ট করে দেন, এর যথাযথ জবাব দিতে হবে। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি না থাকলে এ ধরনের নজিরবিহীন সেনা অভিযান করা যায় না।’’ রাঠৌর একা নয়, বিজেপি মুখপাত্র সম্বিত পাত্র বলেন, ‘‘সন্ত্রাস দমনে সরকার যে কোনও রকম সহিষ্ণুতা দেখাচ্ছে না এ ঘটনায় তাই প্রমাণিত হচ্ছে।’’ সন্দেহ নেই, ঘটনাটিকে সামনে রেখে জাতীয়তাবাদের আবেগে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করেছে বিজেপি। অনেকেই মনে করছেন, এর থেকে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টাও করবে তারা।
কিন্তু কংগ্রেস কী বলছে? অসমের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ মায়ানমারে গিয়ে জঙ্গিঘাঁটি ধ্বংসের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে এ জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ভবিষ্যতেও এমন অভিযান চালানো দরকার, যাতে জঙ্গি কার্যকলাপ সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করা যায়। একই সুরে কংগ্রেস মুখপাত্র অজয় মাকেন বলেন, ‘‘সফল অভিযানের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আমরা অভিনন্দন জানাচ্ছি।’’ স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, মোদী সরকারের প্রশংসা কেন করছে না কংগ্রেস! কারণ, সেনা অভিযান একটা দিক মাত্র। সেই অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া, মায়ানমার জুন্টা সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক দৌত্য এ সব সরকারই করেছে। জবাবে মাকেন বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে রাজনীতি টেনে আনা ঠিক হবে না। ১৮ জন সেনা জওয়ানের মৃত্যুর ঘটনা ছিল মর্মস্পর্শী। তা ছাড়া, জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য ২০১০ সালেই মায়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল নয়াদিল্লি।’’
তবে ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা বলেন, কার্গিল সংঘর্ষের সময় কংগ্রেসের মধ্যে যে ধন্দ তৈরি হয়েছিল এখনও সেটাই ফিরে আসছে। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই মনে করেন, জঙ্গি হামলায় মণিপুরে সেনা জওয়ানের মৃত্যুর ঘটনা ছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি ও সেনা গোয়েন্দাদের বড় ব্যর্থতা। হামলার খবর কেন আগে জানা গেল না তা নিয়েই প্রশ্ন ওঠা উচিত। কিন্তু গত কালের সেনা অপারেশনের পর এখন সেই প্রশ্ন তুলতে চেযেও বিপাকে কংগ্রেস। কেননা, তাতে মনে হতে পারে, কংগ্রেস জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধাচারণ করছে। কংগ্রেসের ওই নেতার কথায়, কার্গিলের সময়ে ভারতের জমিতে পাক সেনা ঢুকে পড়ার খবর বাজপেয়ী সরকার জানতেই পারেনি। পাক সেনার আক্রমণে যখন অসংখ্য ভারতীয় সেনার মৃত্যু হয় তখনও সরকারের সমালোচনা করতে পারেনি কংগ্রেস। উল্টে কার্গিল জয়ের পর জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী।
শুধু এই সংশয়ে থেকে যাওয়াই নয়, কংগ্রেস নেতারা এ-ও বুঝতে পারছেন জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনাতেও আপাতত তালা লাগাতে হবে। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকার গঠনের পর সীমান্তে পাকিস্তান ও চিন বারবার সংঘর্ষ-বিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটায়। তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় তুলতে চেয়েছিল কংগ্রেস। সনিয়ার বক্তব্য ছিল, সরকারের আসার আগে পাক ও চিনের এই আচরণের বিরুদ্ধে গরম গরম কথা বলতেন মোদী। চিনকে লাল চোখ দেখানোর কথা বলতেন। কিন্তু সীমান্তে এত অশান্তির পরেও প্রধানমন্ত্রী নীরব কেন?
আদতে সীমান্তে পাকিস্তান সংঘর্ষ-বিরতির শর্ত লঙ্ঘন করলে নয়াদিল্লিও চুপ করে বসে থাকেনি। পাল্টা আঘাত হানার খবর আসছিল সীমান্ত থেকে। কিন্তু সেই কথাটা সরকারি ভাবে বলা হয়নি। এই সুযোগটাই কংগ্রেস নিতে চেয়েছিল।
কিন্তু মণিপুর-মায়ানমারের ঘটনা তাদের সেই রাজনীতির দরজায় আপাতত তালা লাগিয়ে দিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy