জঙ্গলে ঢাকা এই পথ পেরিয়ে পৌঁছতে হয় অর্জুনের বাড়ি। নিজস্ব চিত্র।
২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে শিলচরের জনসভায় নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘‘আমরা ক্ষমতায় এলে অর্জুন নমঃশূদ্রের মতো আর কাউকে
মরতে হবে না।’’
কে এই অর্জুন নমঃশূদ্র, মোদীর বক্তৃতায় যিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন! এখন কেমন আছেন আত্মঘাতী অর্জুনের পরিবার? উত্তর মিলল শিলচর শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে জলঘেরা গ্রাম হরিটিকরে গিয়ে। পুরো এলাকা বছরের ৮ মাস জলে ডুবে থাকে। স্থানীয় ভাষায় হাওড়। তাই নৌকাই হাওড়বাসীর চলাচলের প্রধান ভরসা। নৌকা থেকে নেমে হাঁটু-সমান কাদা ঠেলে পৌঁছতে হয় অর্জুনের বাড়ি। ওই বাড়িতে এখন সত্তরোর্ধ্ব আকল নমঃশূদ্র একা থাকেন। অর্জুনের মা। কোনও দিন খাবার জোটে। কোনও দিন জোটে না।
ছেলের প্রসঙ্গ তুলতেই জলে ঝাপসা চোখ। আঁচলে মুছে বলেন, ‘‘কে আর খোঁজ রাখে আমাদের! শুধু দু’মুঠো ভাতের জন্য পরিবারটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।’’ অর্জুনের স্ত্রী বাসনা করিমগঞ্জ জেলার শ্রীগৌরীতে এক বাড়িতে কাজ করেন। বছর সাতেকের ছোট ছেলে মায়ের সঙ্গে থাকে। বড় ছেলে বিজন আছে এক কাপড়ের দোকানে। আর এক ছেলে ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে গিয়েছে এলাকারই এক জন। সেখানে তারা কাজ করে। তার ফাঁকে পড়ে।
আরও পড়ুন: নাগরিক পঞ্জির শহিদদের স্বজন আজও লড়াইয়ে
দিল্লিতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে বাড়িতে ছুটে এসেছিলেন সর্বানন্দ সোনোয়াল। নরেন্দ্র মোদীর মুখে উচ্চারিত নাম বলেই হয়তো! অর্জুনের স্ত্রীর হাতে ১০ হাজার টাকা তুলে দিয়ে বলেছিলেন, প্রতি মাসে নিয়মিত কিছু টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। পরে কানাকড়িও মেলেনি। সর্বানন্দ আজ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
কথা রাখেননি মোদীও। তিনি অর্জুনের কথা টেনে সে-দিনের জনসভায় বলেছিলেন, ‘‘আমরা ক্ষমতায় এলে ডি-ভোটার বা সন্দেহভাজন বিদেশি বলে কিছু থাকবে না। গুঁড়িয়ে দেব ডিটেনশন ক্যাম্প।’’ মোদী জমানার চার বছর পেরিয়ে আর একটা ভোট চলে এল, রেহাই মেলেনি ডি-যন্ত্রণা থেকে।
স্বামীকে হারিয়ে বাসনার উদ্বেগ এখন বাবা-ভাইদের নিয়ে। গত বছর বিদেশি সন্দেহে নোটিস গিয়েছে অর্জুনের শ্বশুর-শাশুড়ি এবং তিন শ্যালকের নামে। প্রায় প্রতি মাসে ফরেনার্স ট্রাইবুনালে হাজির হতে হয়। উকিল-মুহুরির ফি আর গাড়িভাড়া দিতে গিয়ে দিনমজুর পরিবারটির ঋণের বহর বাড়ছে। চিন্তায় অর্জুনের শাশুড়ি সাবিত্রী বিশ্বাস। বললেন, ‘‘মাঝেমধ্যেই মনে হয়, আর পারি না, অর্জুন ঠিক কাজই করেছে।’’ পরে নিজেই বলেন, ‘‘এত সহজে লড়াই ছাড়ব না। ১৯৭১ সালের আগের কত কাগজ আমাদের! জমির দলিল, ভোটার তালিকা…।’’
আকলদেবী বললেন, ‘‘১৯৭১ সালের আগের ওই কাগজপত্র হাতে নিয়েই তো অর্জুন সকলকে বলে বেড়াত, তবু কি আমাকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাবে?’’ কিন্তু তার পরেও ২০১২ সালের ৮ জুন সকালে নিজের ঘরে ফাঁসিতে ঝুলে পড়েছিলেন চার সন্তানের বাবা অর্জুন নমঃশূদ্র। ছ’বছর পরে তাঁর বৃদ্ধা মা দুপুর হলে দাওয়ায় খিদে নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন, যদি পড়শিরা কেউ ডাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy