ইজরায়েলি অকুপেশন ফোর্সের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্লোগানগুলো হয়তো এখনও তাঁর কানে বাজছে! সকালে রামাল্লা থেকে বেরিয়ে আবু দিসের পথেই চাক্ষুষ করেছেন সংঘাত ও উত্তেজনার কোলাজ! ডানে-বামে কোনটা প্যালেস্তাইনের ভূখণ্ড, আর কোনটাই বা ইজরায়েলের অধিকৃত বসতি— প্রতিনিয়ত যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল! পাহাড়ের ভাঁজে হঠাতই উঠে যাওয়া পাঁচিল! আবার সেই পাঁচিল তোলার বিরুদ্ধে তারই গায়ে ভেঙে দেওয়ার দেওয়াল লিখন! নিরীহ প্যালেস্তিনীয় মহিলা শিশুদের হত্যার বিরুদ্ধে আল কুদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-যুবর উদ্দাম বিক্ষোভও হয়তো বা তাঁর মন ভিজিয়ে দিয়েছিল ক্ষণিকের জন্য! হয়তো বা মনে পড়িয়ে দিয়েছিল একদা প্যালেস্তাইনকে নিয়ে কলকাতার এমনই আবেগের কথা। তবু সংঘাত-উত্তেজনার সেই আবহকে পিছনে রেখে মালে আদুমিম চেক পয়েন্ট দিয়ে দুপুরে ইজরায়েল সীমান্তে প্রবেশ করে গেলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া কূটনীতিকদের অনেকের মতে ঐতিহাসিক বললেও নাকি কম বলা হবে এই মুহূর্তটাকে! বরং তাঁরা মনে করছেন, এ হল ভারতীয় কূটনীতির রেনেসাঁ।
কেন? কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙে যাচ্ছে, তখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে পরিবর্তিত সমীকরণের আবহে কেন্দ্রে নরসিংহ রাও সরকার ইজরায়েলের সঙ্গে প্রথম বার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল ঠিকই। তবু প্যালেস্তাইন নিয়ে ঘরোয়া আবেগ ও তাকে ঘিরে রাজনীতির কারণে সিকি শতাব্দী ধরে তা যথাসম্ভব কার্পেটের তলাতেই মুড়ে রেখেছিল নয়াদিল্লি। কিন্তু রাতারাতি সেই পর্দাটাই আজ সরিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নয়াদিল্লির সেই পরিবর্তিত কূটনৈতিক অবস্থানের বার্তা নিয়েই এই প্রথম জেরুজালেম এসে পৌঁছলেন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি। নইলে চার দশক ধরে কংগ্রেসি রাজনীতিতে থেকে কবেই জেরুজালেম সফরের কথা ভেবেছিলেন প্রণববাবু! কেন্দ্রে ইউ পি এ সরকারের প্রতিরক্ষা বা বিদেশমন্ত্রী হিসাবেও সে কথা মাথাতেও আনেননি। কিন্তু তাঁকেই আজ কাণ্ডারী নরেন্দ্র মোদী সরকার বুঝিয়ে দিল ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্বাধীন, প্যালেস্তাইনের থেকে স্বতন্ত্র। ঘরোয়া নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ককে এ বার নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে নয়াদিল্লি। সন্ত্রাস দমনে মোসাদের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য সমন্বয়, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আদানপ্রদান, ভারতে প্রতিরক্ষা উতপাদন শিল্পে ইজরায়েলি বিনিয়োগ আর রাখ ঢাক করে হবে না। হবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করে।
আবার উভয়ের মধ্যে সংঘাত থাকলেও রামাল্লা-নয়াদিল্লি অক্ষ নিয়ে না করল না ইজরায়েলও। বরং ভারতীয় রাষ্ট্রপতির সফরের প্রাক সন্ধ্যায় গতকাল বিবৃতি দিয়ে জেরুজালেম জানিয়ে দিয়েছিল, প্যালেস্তাইনের সঙ্গে ভারতের সুষ্ঠু সম্পর্কে তাদের আপত্তি নেই। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি এই প্রথম যে জেরুজালেম আসছেন সেটাই বড় কথা! নয়াদিল্লির সঙ্গে কৌশলগত ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছে ইজরায়েল! ভারতীয় রাষ্টপতিকে অভ্যর্থনা জানাতে জেরুজালেমের আয়োজন, রাস্তার দুধারে কৌতুহলী ভিড়, রাজপথ জুড়ে ছেয়ে থাকা দুদেশের পতাকাও যেন সেই বার্তাই দিতে চাইল আজ। দুপুরে জেরুজালেম পৌঁছে আজ বিশেষ কর্মসূচি ছিল না রাষ্ট্রপতির। বিকেলে মাউন্ট হার্জল-এ বিশ্ব ইহুদি কেন্দ্র ঘুরে দেখেন তিনি। পরে হলোকাস্ট রিসার্চ সেন্টার ঘুরে দেখেন। কাল তাঁকে আনুষ্ঠানিক ভাবে অভ্যর্থনা জানাবেন ইজরায়েলি রাষ্ট্রপতি রুভেন রিভলিন। পরে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে। তার পর রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে ইজরায়েলের সঙ্গে ডবল ট্যাক্সেশন অ্যাভয়ডেন্স চুক্তি সই করবে নয়াদিল্লি। তাছাড়া কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তর, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে এক গুচ্ছ সমঝোতা সই হবে দুদেশের মধ্যে। রাষ্ট্রপতির সফরের এই ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আগামী বছর ইজরায়েল সফরে আসার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy