Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বিচ্ছেদ তিন তালাকে, মাজু খাতুনরা আঁধারেই

শীত পড়তেই খেজুর গাছে উঠে রস পেড়ে আনে পেশায় শিউলি মোতালেফ, যার ডাক নাম মতি। তরিবত করে জ্বাল দিয়ে মাজু খাতুন সেই রস থেকে এমন স্বাদু গুড় বানায়, যা মারমার কাটকাট করে বিকোয়। এক মরসুমের শুরুতে গুড় বানানোর মজুরির পয়সা না-দেওয়ার নতুন মতলব আঁটে মোতালেফ। রসের কারিগর বিধবা মাজুকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় সে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৫৭
Share: Save:

শীত পড়তেই খেজুর গাছে উঠে রস পেড়ে আনে পেশায় শিউলি মোতালেফ, যার ডাক নাম মতি। তরিবত করে জ্বাল দিয়ে মাজু খাতুন সেই রস থেকে এমন স্বাদু গুড় বানায়, যা মারমার কাটকাট করে বিকোয়। এক মরসুমের শুরুতে গুড় বানানোর মজুরির পয়সা না-দেওয়ার নতুন মতলব আঁটে মোতালেফ। রসের কারিগর বিধবা মাজুকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় সে। মাজু না-বুঝে রাজি হওয়ায় সে বিয়ে হয়েও যায়। সে বার বেশ দু’পয়সা মুনাফা করে মতি। কিন্তু মরসুম শেষে মাজুকে তালাক দিয়ে নিজের মনের মানুষ ফুল বানুর কাছেই ফিরে যায় মোতালেফ।

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’ গল্পের নায়িকা মাজু খাতুনের ভাগ্য-বিড়ম্বনা এই ২০১৫-তেও বদলানোর কোনও লক্ষণ নেই। তিন বার তালাক উচ্চারণ করে বিচ্ছেদের এই সহজ পন্থা বহু মুসলিম মহিলার জীবনে যে বিপর্যয় নিয়ে এসেছে, তা নিয়ে অনেকেই সরব হয়েছেন। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ৯০ শতাংশের বেশি মুসলিম মহিলারা চান, এই মৌখিক তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রথা বন্ধ হোক। কিন্তু অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড আজ আবার জানিয়ে দিল, বিবাহ বিচ্ছেদের এই পন্থাই বলবৎ থাকছে।

অল ইন্ডিয়া সুন্নি উলেমা কাউন্সিল মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডকে চিঠি লিখে আর্জি জানায়, এক সঙ্গে তিন বার তালাক বললে সেটিকে শুধু এক বার বলেই ধরা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখা হোক। কারণ, অনেক সময় অনেকে রাগের মাথায় তিন বার তালাক বলে পরে আফশোস করেন। কিন্তু এই প্রস্তাব আজ খারিজ করে দিয়েছে পার্সোনাল ল বোর্ড। বোর্ডের মুখপাত্র মৌলানা আব্দুল রহিম কুরেশি বলেন, কোরান ও হাদিসে একই সঙ্গে তিন বার তালাক বলা অপরাধ। কিন্তু তিন বার বলে ফেললে বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয়ে যায়। এই ব্যবস্থা বদলানো যাবে না।

সম্প্রতি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষায় উঠে এসেছে— ৯২ শতাংশ মুসলিম মহিলা এই প্রথা বিলোপের পক্ষে। তার ওপর ফেসবুক, স্কাইপের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার রেওয়াজও আজ বেড়েছে। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে— এই প্রথা এখনও যাঁরা মেনে চলেন, তাঁদের প্রায় ৭৫ শতাংশের পারিবারিক আয় বছরে ৫০ হাজার টাকার কম। আর ৫৫ শতাংশ মহিলার বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের নীচে। সিংহ ভাগ মহিলার নিজের নামে কোনও সম্পত্তি নেই। কোনও আয়ও নেই। প্রথাগত শিক্ষাও নেই সিংহ ভাগ মহিলার। ফলে স্পষ্ট, সমাজের পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের মধ্যেই এ ভাবে তালাক দেওয়ার প্রবণতা বেশি। বিচ্ছেদের পরে যাঁদের জীবনে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নেমে আসে়।

কেন্দ্রের সংখ্যালঘু দফতরের প্রতিমন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি মনে করেন, ‘‘সংখ্যালঘু সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলি শরিয়ত আইন খুব একটা মানেন না। মুসলিম ধর্মাবলম্বী সরকারি কর্মীদের বিবাহ বিচ্ছেদ করতে হলেও দেশের আইন মেনেই তা করতে হয়। শিক্ষার আলোই একমাত্র সচেতনতা আনতে পারে।’’ মন্ত্রীর মতে, মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড আজ তিন বার তালাকের প্রথা বজায় রাখার কথা বললেও সেটিই যে শেষ কথা, এমন নয়। সরকারেরও এ ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা নেই।

তালাকের বিষয়টি নিয়ে যে নতুন করে বিতর্ক শুরু হল, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যেও এই নিয়ে মতভেদ আছে। সুন্নি প্রথা অনুযায়ী, প্রতিটি তালাক বলার মাঝে তিন মাস অপেক্ষা করা উচিত। দু’বার তালাক দেওয়ার পরেও ফের বোঝাপড়ার অবকাশ থাকে। কিন্তু অবশেষে যদি তৃতীয় বার তালাক দেওয়া হয়, তবেই বিচ্ছেদের প্রথা সম্পূর্ণ হয়। এই বিস্তৃত সময়ের
মধ্যে পরিবারের কেউ মধ্যস্থতাও করতে পারেন। শিয়াদের মধ্যে তালাকের সময় দু’জন করে সাক্ষী রাখার রেওয়াজও আছে। কিন্তু কালক্রমে প্রতিটি তালাক বলার জন্য তিন মাসের সময় দেওয়ার বদলে এক বারে একসঙ্গেই তা বলে বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ করা যাচ্ছে।

অল ইন্ডিয়া সুন্নি উলেমা কাউন্সিল যেমন আপত্তি তুলেছে, তেমনই অল ইন্ডিয়া শিয়া পার্সোনাল ল বোর্ডও মনে করে এই প্রথা বন্ধ হওয়া উচিত। শিয়া পার্সোনাল ল বোর্ডের মুখপাত্র মৌলানা ইয়াসুব অব্বাস বলেন, ‘‘কোনও মহিলা বিয়ের পর নিজের পরিবার ছেড়ে বাকি জীবনটা স্বামীর সঙ্গে কাটাতে যান। স্বামী রাগের বশে তিন বার তলাক বললে সেই মহিলার জীবনও তো শেষ হয়ে গেল। উলেমাদের উচিত, এক সঙ্গে বসে এই বিষয়টি আলোচনা করা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE