Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সবই কূটনীতির অঙ্গ, বলছে সাউথ ব্লক

ওবামার খোঁচায় উদ্বিগ্ন নয় ভারত

চায়ের আসরে মৈত্রীর কোনও অভাব ছিল না। জট খুলেছিল পরমাণু চুক্তিরও। তবু ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেই গিয়েছিলেন বারাক ওবামা। গত কাল নিজের দেশে ন্যাশনাল প্রেয়ার-এর বক্তৃতায় আরও চড়া সুরে সে কথা উঠে এল ওবামার মুখে। ভারত সফরের কথা স্মরণ করেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বললেন, “এত সুন্দর, এত বৈচিত্রে ভরা দেশ! কিন্তু সেখানে গত কয়েক বছরে এক ধর্মের হাতে অন্য ধর্মের মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন! এই অসহিষ্ণুতা দেখলে গাঁধী অত্যন্ত মর্মাহত হতেন!”

ন্যাশনাল প্রেয়ার ব্রেকফাস্টের বক্তৃতায় বারাক ওবামা। ছবি: এএফপি।

ন্যাশনাল প্রেয়ার ব্রেকফাস্টের বক্তৃতায় বারাক ওবামা। ছবি: এএফপি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪০
Share: Save:

চায়ের আসরে মৈত্রীর কোনও অভাব ছিল না। জট খুলেছিল পরমাণু চুক্তিরও। তবু ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেই গিয়েছিলেন বারাক ওবামা। গত কাল নিজের দেশে ন্যাশনাল প্রেয়ার-এর বক্তৃতায় আরও চড়া সুরে সে কথা উঠে এল ওবামার মুখে।

ভারত সফরের কথা স্মরণ করেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বললেন, “এত সুন্দর, এত বৈচিত্রে ভরা দেশ! কিন্তু সেখানে গত কয়েক বছরে এক ধর্মের হাতে অন্য ধর্মের মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন! এই অসহিষ্ণুতা দেখলে গাঁধী অত্যন্ত মর্মাহত হতেন!”

ওবামার এই বক্তব্য ভারত-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে কি না, প্রত্যাশিত ভাবেই সেই জল্পনা ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এ বারের প্রজাতন্ত্র দিবসে অতিথি হয়ে এসে ওবামা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে যে নজর-কাড়া উষ্ণ বন্ধুত্বের সাক্ষ্য রেখে গিয়েছেন, তার পরে বারবার ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে মুখ খোলা কি কিছুটা বেসুরো নয়?

ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক অবশ্য বিষয়টিকে খুব উদ্বেগের বলে মনে করছে না। বরং ঘরোয়া আলোচনায় তাদের বক্তব্য, নরেন্দ্র মোদীকে দীর্ঘদিন ভিসা দিতে নারাজ ছিল আমেরিকা। এ বারে ঘটা করে সেই মোদীর সঙ্গেই মৈত্রীর বার্তা দিতে গিয়ে ওবামা ঘরোয়া রাজনীতিতে কিছুটা চাপের মুখে পড়েছেন। সেই চাপ প্রশমিত করতে ওবামাকে ফের অসহিষ্ণুতা নিয়ে তোপ দাগতে হলো বলে মনে করছেন বিদেশ মন্ত্রকের কর্তারা।

তবে আপাত ভাবে ঘটনাটি ভারত সরকারের পক্ষে যথেষ্ট অস্বস্তিজনক, এ কথা ঠিক। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করে তড়িঘড়ি কোনও প্রতিক্রিয়া দিয়ে জল আরও ঘোলা করতে চাইছেন না মোদী। কারণ ঘরের মাটিতে চাপ তাঁরও কিছু কম নয়। কেননা একই ভাবে ভারতেরও একটি অংশ মনে করে, দিল্লি বড় বেশি করে চিন-বিরোধী অক্ষের (জাপান-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া) শরিক হয়ে পড়ছে আজকাল। ভারসাম্য ঠিক রাখতে তাই মোদীকেও ওবামা সফরের ঠিক পরপরই চিন সফরের তোড়জোড় করতে হচ্ছে। বিষয়টি ওবামার কাছে সুখকর হবে না জেনেও। মে মাসেই চিন যাবেন মোদী। তার আগে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ চিন ঘুরে এসেছেন। চিন ও রাশিয়ার সঙ্গে একত্রে বৈঠক করে এসেছেন। পুরনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার কূটনৈতিক দায়িত্ব যদি ভারতকে পালন করতে হয়, ওবামাকেও সেটাই করতে হবে এ কথা দিল্লির অজানা নয়।

সরকারি ভাবে তাই ওবামার বক্তব্য নিয়ে মুখ খোলেনি ভারত। তবে দলের পক্ষ থেকে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বিজেপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি আজ এই প্রসঙ্গে ভারতের সহিষ্ণুতার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের কথাই নতুন

করে মনে করিয়ে দিয়েছেন। প্রাতরাশ বৈঠকের যে অনুষ্ঠানে ওবামা এই সব কথা বলেছেন, সেখানে তাঁর পাশেই ছিলেন দলাই লামা। সেটাকে কাজে লাগাতে চাইছে দিল্লি। জেটলির কথায়, “ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রশ্নে ভারতের

দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনায় তা নষ্ট হওয়ার নয়। প্রাতরাশ বৈঠকে ওবামার পাশেই বসেছিলেন দলাই লামা। এই উদাহরণটিই এ প্রসঙ্গে যথেষ্ট।’’

ভিতরে ভিতরে কিছুটা উদ্বেগ তবু রয়ে যাচ্ছে। ২৭ জানুয়ারি সিরি ফোর্ট অডিটোরিয়ামের বক্তৃতায় ভারতীয় সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদ তুলে এনে সব ধর্মের সমানাধিকারের কথা মনে করিয়েছেন ওবামা। সরকারের একটি অংশ মনে করে, এ ভাবে ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভারতের সংবিধান উদ্ধৃত করে ভারত সরকারকে উপদেশ দেওয়াটা যথেষ্ট অনুচিত কাজ হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের। ঘটনাচক্রে এ বারের প্রজাতন্ত্র দিবসের বিজ্ঞাপনেই সংবিধানের পুরনো সংস্করণের ছবি ছেপে প্রস্তাবনা থেকে ‘সমাজতন্ত্রী’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দু’টি বাইরে রেখেছিল কেন্দ্র।

তবে বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, কূটনীতিতে এই ধরনের পরিস্থিতি আসে এবং তার মোকাবিলা করতে হয় ধৈর্যের সঙ্গে। ওবামার নিজের ঘরোয়া বাধ্যবাধকতার দিকটিকে তাই হিসেবের মধ্যে রাখছে সাউথ ব্লক। তারা জানে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে বছরের পর বছর মার্কিন ভিসা না-পাওয়া মোদীর সঙ্গে ওবামার চূড়ান্ত ঘনিষ্ঠতা সমালোচনার চোখে দেখেছে সেনেটের একটি অংশ। ভারতে সম্প্রতি বিভিন্ন গির্জায় অশান্তির ঘটনাও মার্কিন সংবাদমাধ্যমের নজর এড়ায়নি।

কূটনৈতিক শিবিরের মতে, বিদেশনীতিতে নরম এবং গরম দু’টি পন্থা একসঙ্গে নিয়ে চলাটাই দস্তুর। ভারত নিজেও তাই-ই করে। ওবামাও তা-ই করছেন।

তবে গোটা ঘটনায় বিরোধীরা চুপ করে নেই। কংগ্রেস নেতা অজয় মাকেনের কথায়, “মোদী যেমন ভাবে দেশকে নিজে দেখছিলেন, সেভাবেই ওবামাকে দেখাতে চেয়েছিলেন । কিন্তু সুখবর হল ওবামা বিভ্রান্ত হননি।” কংগ্রেস সূত্রের বক্তব্য, কেন্দ্রে নতুন সরকার আসার পর থেকে গোষ্ঠী সংঘর্ষ ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে। কংগ্রেস নেতাদের মতে, ওবামার সফরকে দিল্লি ভোটের আগে একটা রাজনৈতিক অস্ত্র করতে চাইছিল মোদী। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট সেটা বুঝতে পেরে মোক্ষম সময়ে তার জবাবটি দিলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

religious intolerance obama india
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE