Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
ক্ষোভ বাড়ছে পুরীতে

মৃত্যু ঠেকানো যেত না, বলছে ওড়িশা সরকার

ভগবানের নবকলেবরে ব্রহ্ম পরিবর্তনের গেরোয় বিভ্রাট শুরু হয়েছিল। তাঁর রথযাত্রার পরে ভক্তদের সামনে এখন প্রকট ‘দলাচাপ্টা’ আর ‘ঠেলাপেলা’র অভিযোগ। দেড় মাস বাদে ঈশ্বর দর্শনের উন্মাদনায় বিহ্বল জগন্নাথধামেও এর আঁচ এড়ানো যাচ্ছে না।

হাসপাতালে ভর্তি ভিড়ে আহত বংশীবদন ঠাকুর। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

হাসপাতালে ভর্তি ভিড়ে আহত বংশীবদন ঠাকুর। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

ঋজু বসু
পুরী শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৫ ০২:৫৯
Share: Save:

ভগবানের নবকলেবরে ব্রহ্ম পরিবর্তনের গেরোয় বিভ্রাট শুরু হয়েছিল। তাঁর রথযাত্রার পরে ভক্তদের সামনে এখন প্রকট ‘দলাচাপ্টা’ আর ‘ঠেলাপেলা’র অভিযোগ।

দেড় মাস বাদে ঈশ্বর দর্শনের উন্মাদনায় বিহ্বল জগন্নাথধামেও এর আঁচ এড়ানো যাচ্ছে না। ‘দলাচাপ্টা’ বা পদপিষ্ট হয়ে ভক্তদের মৃত্যুর অভিযোগ অবশ্য প্রাণপণে খণ্ডন করতে তত্পর উত্কলীয় পুলিশ-প্রশাসন। রথযাত্রায় সামিল ভক্তদের মধ্যে মৃতের সংখ্যা রবিবার বাড়েনি। এখনও পর্যন্ত দু’জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। এ ছাড়া, ‘ঠেলাপেলা’য় জনা পঞ্চাশেক মানুষ আহত হয়েছেন। প্রশাসন জানিয়েছে, গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন শ’খানেক দর্শনার্থী।

মন্দিরের সিংহদুয়ারে রথের কাছাকাছি দিনভর দাঁড়িয়েই অন্তত ৫০ জনকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যেতে চোখে পড়েছিল কাল। এই বিপত্তি ঠেকানো যে সম্ভব ছিল না তা আজ প্রাণপণে বলার চেষ্টা করছে সরকার।

সামনের বাধা উড়িয়ে দূর্বার গতিতে জগন্নাথের রথযাত্রা থেকেই ইংরেজি ‘জুগেরনাট’ শব্দের জন্ম। প্রভুর রথ থামানো নাকি কারও সাধ্য নয়। এক দিক দিয়ে কথাটা যে ভুল নয়, তা এখন বুঝিয়ে বলছেন ওড়িশা পুলিশের কর্তারা। কাল দিনভর অবিশ্বাস্য ভিড় সামলাতে গিয়ে জেরবার হয়েছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, চাঁদি ফাটা রোদ আর অসহ্য আদ্রর্তার মহাজোট তো ছিলই। সেই সঙ্গে সাবেক পরম্পরা আর আধুনিক পুলিশি ব্যবস্থার সংঘাতও যেন এই রথযাত্রায় জোড়া মৃত্যুকে অনিবার্য করে তুলেছিল।

কেন? রথযাত্রা সামলানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত স্পেশ্যাল আইজি সৌম্যেন্দ্র প্রিয়দর্শী এ দিন জানান, রথ টানার পরম্পরা এই একুশ শতকে নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করা শুধু মুশকিল নয়, না-মুমকিন। ‘‘অনেকেই বলেন, কেন তিনটে রথ দেখা বা কাছাকাছি আসার জন্য লাইনের ব্যবস্থা করা হয় না। এক একটি রথের জন্য চারটে লাইন আর প্রতি দর্শনার্থীর রথ-দর্শনের সময় চার সেকেন্ড করে ধরলেও ২৪ ঘণ্টাতেও পুরো ভিড়টার ভগ্নাংশমাত্র সেই সুযোগটা পেত,’’— ব্যাখ্যা করলেন প্রিয়দর্শী। ফলে, বড় দণ্ড ঘিরে এক-একটি অংশে ব্যারিকেড করা ছাড়া উপায় থাকে না। রথ যত এগিয়ে আসে ব্যারিকেড আস্তে আস্তে খুলে দেওয়া হয়।

জগন্নাথের রথে আসীন, প্রবীণ মুখ্য দয়িতাপতি জগন্নাথ সোয়াঁইন মহাপাত্র থেকে শুরু করে প্রিয়দর্শী নিজে, কেউ মনেই করতে পারছেন না, রথযাত্রায় এর আগে কখনও এমন ভিড় দেখেছেন বলে। ভুবনেশ্বর থেকে পুরী ঢোকার রাস্তায় বিস্তর বিধিনিষেধ জারি হয়েছিল গত তিন দিন ধরে। পুরী শহরের গলিতে গলিতেও ছিল ব্যারিকেডে। যা ভেঙে এগোনোই মুশকিল। তবু ভক্তেরা কী ভাবে কে জানে, বড় দণ্ডে ঠিক ঠাঁই করে নিয়েছিলেন।

প্রিয়দর্শীর মতে, স্রেফ রশি ধরে রথ টানার সেই মান্ধাতার আমলের রীতিও পুলিশের কাজটা অসম্ভব করে তুলেছিল। প্রতিবারই সব ভক্ত রথের দড়ি ছুঁয়ে তা টানতে মুখিয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার ভুল করে পুলিশি ঘেরাটোপের দড়ি ধরেও টানতে থাকেন। ভক্তদের সবার হাতে দড়ি গেলে রথ যে কোন দিক থেকে কোন দিকে ঘুরবে, তা-ও ঠাহর করা মুশকিল। গোটা ভিড়টাকে রথের দিকে না-আসার জন্য সারা ক্ষণ মাইকে নিষেধ করা হয়। কিন্তু পুণ্যের লোভে কে শোনে কার কথা! দড়ি ছোঁয়ার টানে জনতার উন্মাদনায় মৃত্যু তাই অনিবার্য হয়ে ওঠে বলে ব্যাখ্যা পুলিশের।

কাল যেমন হয়েছে। পুলিশের দাবি, বিকেল পাঁচটা নাগাদ এক বৃদ্ধা বলভদ্রের রথ ছুঁতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ওড়িশার ডিজিপি সঞ্জীব মারিক সাফ বলছেন, ‘‘অনেকেই বৃদ্ধ মা-বাবাকে রথে একা ছেড়ে দেন। কিছু ক্ষেত্রে অন্ধ বিশ্বাস জীবন বিপন্ন করে তোলে।’’

পুরীর এসপি আশিস সিংহেরও আফসোস, ‘‘জগন্নাথের কৃপায় রথে বৃষ্টি বা ‘কাদুয়া গুন্ডিচা’ হলে কিন্তু এমন হতো না।’’ স্বেচ্ছাসেবীরা দিনভর জল ছিটিয়ে, ঢালাও গ্লুকোজ, জল, স্কোয়াশ, লজেন্স বিলি করেও মানুষের কষ্ট ঠেকাতে পারেননি। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আর এক বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে গৌড়ীয় মঠের কাছে বসে পড়েন। তিনিও পরে মারা যান।

দু’টি মৃত্যু ঘটেছে ভিন্ন সময়ে। আর এটা দেখেই ‘দলাচাপ্টা’র তত্ত্ব খারিজ করতে ব্যস্ত পুলিশকর্তা থেকে বিজেডি বিধায়ক, নবকলেবরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহেশ্বর মোহান্তি কিংবা জগন্নাথ মন্দিরের মুখ্য প্রশাসক সুরেশ মহাপাত্র। আজ অবশ্য প্রশ্ন উঠেছে, বেলা ১২টার কিছু পরে জগন্নাথের পহুন্ডি বা রথারোহণ পর্ব চুকে গেলেও কেন রাজা আসতে দেরি করলেন? সুরেশ মহাপাত্রের বক্তব্য, ভিড় ঠেলে রাজার আসার ব্যবস্থা করতে কিছু সময় লেগেছে। তা-ও বিকেল তিনটে চল্লিশে সময়ের মাত্র ১০ মিনিট পরেই প্রথম রথের রশিতে টান পড়ে।

বলভদ্র ছাড়া অবশ্য সুভদ্রা আর জগন্নাথের রথ কাল রাতে গুন্ডিচা পৌঁছতে পারেননি। মন্দিরের সামান্য দূরে থেমে যায় সুভদ্রার রথ। আর জগন্নাথদেব তখন বেশ খানিকটা দূরে বড় শঙ্খে, ‘মাসুমা মন্দির’ বা গোকুলের দেবকীর বাড়ির কাছে। এ দিন সকালে জগন্নাথের রথ টানতে আর এক প্রস্থ উন্মাদনা দেখা গেল।

রীতিমাফিক, রবিবারের রাতটাও দই-খই-নারকোল-মিষ্টি খেয়ে রথেই কাটাচ্ছেন জগন্নাথ-বলভদ্র-সুভদ্রা। তাঁদের ঘিরে মস্ত ব্যারিকেড। পাণ্ডাদের হাতে ১০ টাকা দিয়ে নারকোল ফাটানোর পুণ্য করছেন ভক্তেরা। ভগবান রথে বা পথে থাকার সময়ে তাঁর কাছে জাতবিচার নেই। এখন তিনি সবার ভগবান। ইহুদি বাবা আর ক্যাথলিক মায়ের ছেলে নিউ ইয়র্কের বেকারি-মালিক মার্ক ইজরায়েল তো গদগদ। দেশ-বিদেশ থেকে আসা ভক্তরা প্রভুকে দেখে কেঁদে সারা হচ্ছেন।

আপাতত পুরীর পথবাসী জগন্নাথকে ঘিরে জমজমাট মেলা বসেছে। নিয়মমাফিক, সোমবার সন্ধ্যায় গুন্ডিচা মন্দিরের অন্দরে প্রভুর পদার্পণ বা ‘পহুন্ডি’ শুরুর কথা। তত ক্ষণ পর্যন্ত পথের ঠাকুরকে ঘিরে ভিড়টা প্রশাসনকে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে কই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE