Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

চোখে ভাসছিল নিজের বাচ্চাদের মুখগুলো

কারও হাতে লাঠি, কারও পাথর। মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজ। তখনও ভেবেছিলাম স্কুলবাস দেখে ছেড়ে দেবে ওরা। ভুলটা ভাঙল তক্ষুনিই।

‘পদ্মাবত’-এর একটি দৃশ্যে দীপিকা পাড়ুকোন। ছবি: ইনস্টাগ্রামের সৌজন্যে।

‘পদ্মাবত’-এর একটি দৃশ্যে দীপিকা পাড়ুকোন। ছবি: ইনস্টাগ্রামের সৌজন্যে।

প্রবেশ কুমার (বুধবার আক্রান্ত বাসের চালক)
শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০৩:২৪
Share: Save:

জি ডি গোয়েন্‌কা ওয়ার্ল্ড স্কুল থেকে বাস নিয়ে একটু দূরের বিএসএফ ক্যাম্পটা পর্যন্ত পৌঁছেছি তখন। ঘড়িতে বেলা ৩টে ১০।

গুরুগ্রামের রাস্তায় এত লোক কেন? নিমেষে আমাদের বাসটাকে ঘিরে ফেলল লোকগুলো। কারও হাতে লাঠি, কারও পাথর। মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজ। তখনও ভেবেছিলাম স্কুলবাস দেখে ছেড়ে দেবে ওরা। ভুলটা ভাঙল তক্ষুনিই।

দুম্ করে বোমা ফাটার মতো একটা আওয়াজ! চোখ বুজে ফেলেছিলাম। চোখ খুলে দেখি, সামনের উইন্ডস্ক্রিন চুরমার। তার ভাঙা ঝুরো কাচ আমার সারা গায়ে। শুনতে পাচ্ছি, একটা হইচই চলছে বাসের ভেতরে। নিচু ক্লাসের বাচ্চারা কাঁদছে। কিন্তু ভয়ে পেছনে তাকাতে পারছি না। হেল্পার বিজেন্দ্রকে চাপা গলায় বললাম, ‘‘স্কুলে খবর দে। যা হয় হোক, দরজা খুলবি না।’’ কয়েক হাত দূরে হরিয়ানার একটা সরকারি বাস। সদ্য ভাঙা হয়েছে সেটাকে। আমাদের কী হবে? এতগুলো বাচ্চা, তাদের মধ্যে চার-পাঁচ জন বিদেশি।

জানলা দিয়ে মাথা বাড়াতেই লোকগুলো টেনে-হিঁচড়ে নামাতে গেল আমাকে। বললাম, ‘‘ছোট বাচ্চা আছে। এটা স্কুলবাস। দয়া করে যেতে দিন।’’ বাসে থাকা দিদিমণিরাও একই মিনতি করছিলেন। ওরা তখন বলল, ‘‘জলদি পালা।’’ দশ কিলোমিটার স্পিডে এগোতে লাগলাম। সরতে থাকল ভিড়। ভাবলাম, বাঁচা গেল।

আর তখনই দ্বিতীয় বার ভুল ভাঙল। উড়ে এল আরেকটা ইট। আয়নায় দেখলাম, এ বার আমাদের বাসের একটা জানলার কাচ ভেঙে পড়েছে। ভাগ্যিস ওই জানলাটার ধারে কোনও বাচ্চা ছিল না। আসলে স্কুল থেকে আমাদের প্রায়ই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, এমন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে। দিদিমণিরা তাই প্রথমেই সিটের তলায় কিংবা বাসের মাঝামাঝি জায়গায় উবু হয়ে বসতে বলেছিলেন বাচ্চাদের। আর একেবারে খুদেগুলোকে ঢেকে রেখেছিলেন নিজেদের শরীর দিয়ে। হয়তো তাই ওদের কারও সে ভাবে চোট লাগেনি।

আমার তখন চোখে ভাসছে তিন সন্তানের মুখ। ঠিক করে ফেললাম, আর আস্তে চালানোর কোনও প্রশ্ন নেই। ধাঁ করে স্পিড বাড়াতেই সামনে যারা ছিল, তারা ছিটকে গেল। দু’চার জন লাঠির বাড়ি মারলেও, ভিড়টা সরতেই খালি জায়গা পেয়ে গেলাম। এক নিঃশ্বাসে কয়েক কিলোমিটার চালিয়ে বাস থামালাম। তত ক্ষণে বাচ্চাদের কান্না বন্ধ হলেও সবার চোখে-মুখে প্রচণ্ড ভয়। ওদের কিছু হলে বাড়িতে মুখ দেখাতাম কী করে!

বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই অভিনন্দন জানিয়ে অনেক ফোন আসছে। প্রায় ১৬ বছর গাড়ি চালাচ্ছি এই স্কুলে। এখন মনে হচ্ছে, বুধবারটাই হয়তো ছিল চাকরি-জীবনের সব চেয়ে ‘চ্যালেঞ্জিং’ দিন।

হয়তো সব চেয়ে তৃপ্তিরও।

(জি ডি গোয়েন্কা ওয়ার্ল্ড স্কুলের প্রিন্সিপাল নীতা বালি বলেছেন, ‘‘বাসের কর্মীদের বিশেষ ভাবে পুরস্কৃত করা হবে। বৃহস্পতিবার স্কুল বন্ধ ছিল। আগামী সপ্তাহে স্কুল খুললে বাসে আরও বেশি নিরাপত্তা কর্মী দেওয়া হবে।’’)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE