চার মাস আগেও জামিন মিলেছিল। তবে শর্তসাপেক্ষে। এ বার একেবারে সরাসরি মুক্তির নির্দেশ দিল ইসলামাবাদ হাইকোর্ট! আর তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে ভারত! ২০০৮-এর নভেম্বরে মুম্বই হামলার ধাঁচে আরও হামলার পরিকল্পনা করবে না তো সদ্য মুক্তির নির্দেশপ্রাপ্ত লস্কর-ই-তইবা জঙ্গি জাকিউর রহমান লকভি? মুম্বই হামলায় ধৃত একমাত্র জীবিত জঙ্গি আজমল কাসভদের ‘চাচা’!
শুধু আশঙ্কা নয়। মুম্বই হামলার অন্যতম মস্তিষ্ক লকভির মুক্তি ঘিরে কূটনৈতিক এবং ঘরোয়া স্তরেও যথেষ্ট অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল কেন্দ্রীয় সরকার। পরিস্থিতি আগাম আঁচ করে তাই তড়িঘড়ি সক্রিয় হয়েছে সাউথ ব্লক। শুক্রবার লকভির মুক্তি নিয়ে ইসলামাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি নুরুল হকের নির্দেশ জানার পরেই নিজেদের উদ্বেগ ও ক্ষোভ জানাতে ভারতে নিযুক্ত পাক হাইকমিশনার আব্দুল বসিতকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন ভারপ্রাপ্ত বিদেশসচিব অনিল ওয়াধওয়া। কড়া ভাষায় বসিতকে জানিয়ে দেওয়া হয়, মুম্বই হামলা গিয়ে ভারতের জনমানসে আবেগ এখনও তীব্র। ফলে লকভির মুক্তির নির্দেশে ভারত চরম ক্ষুব্ধ। লকভির মুক্তির ঘটনায় দু’দেশের মধ্যে ভবিষ্যৎ আলোচনার সম্ভাবনা যে সমূলে বিনষ্ট হবে, তা-ও স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সবে মাত্র সার্ক যাত্রার অঙ্গ হিসেবে পাকিস্তান সফর সেরে ফিরেছেন বিদেশসচিব এস জয়শঙ্কর। দ্বিপাক্ষিক স্তরে সার্বিক আলোচনা শুরু হওয়ার মতো একটি পরিবেশ তৈরির জন্য চেষ্টা চলছে দু’দেশের তরফেই। কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, এমন একটা সময়ে লকভির মুক্তির নির্দেশ রীতিমতো তিক্ত করে দিল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে। তা ছাড়া এই মুহূর্তে সংসদের অধিবেশন চলছে। সোমবার অধিবেশন ফের বসলে লকভির মুক্তির বিষয়টি উঠবে। এবং সেখানে বিষয়টি নিয়ে সরব হবেন বিরোধী নেতারা। এ সব মাথায় রেখেই ভারত তার ক্ষোভ স্পষ্ট করে দিয়েছে। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মহম্মদ আকবরুদ্দিন গোটা ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, “সন্ত্রাস নিয়ে পাকিস্তানের দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে জল ঢেলে দিচ্ছে লকভিকে মুক্তির নির্দেশ। এমন একজন ব্যক্তি, যাকে রাষ্ট্রপুঞ্জও জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তাকে ছেড়ে দেওয়ায় একটি বড় বিপদের সম্ভাবনা তৈরি হল।” আমেরিকাও পাকিস্তানকে জানিয়েছে, মুম্বই হামলার চক্রীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে ইসলামাবাদকে।
তবে ভারতের উদ্বেগে যে পাকিস্তান কান দেবে না, তা-ও আজ বোঝা গিয়েছে। বাসিতকে ডেকে পাঠানোর পাল্টা হিসেবে পাকিস্তানও ইসলামাবাদে ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনার জে পি সিংহকে ডেকে পাঠায়। তাঁকে জানিয়ে দেয়, লকভির মুক্তি নিয়ে অনর্থক শোরগোল তুলছে দিল্লি! একই সঙ্গে ভারতের অস্বস্তি বাড়াতে সমঝোতা ট্রেনে বিস্ফোরণের প্রসঙ্গও তুলেছে পাকিস্তান।
লকভির মুক্তির নির্দেশ একটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। তা হল, পাকিস্তানের মাটিতে চলা মুম্বই হামলার চক্রীদের বিচার। যদিও আজ চাপের মুখে পাক হাইকমিশনার মুম্বই সন্ত্রাস নিয়ে সুবিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু ঘটনা হল, তাতে বিশ্বাস করছে না দিল্লি। এ দিন অনিল ওয়াধওয়ার সঙ্গে বৈঠকের পরে বাইরে এসে বসিত বলেন, “লকভি মুক্তি পেলেও মামলাটা চলছে। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি, যাতে মামলাটা দ্রুত সম্পূর্ণ করা যায়।” দিল্লির বক্তব্য, মুম্বই সন্ত্রাসে লকভির যোগ নিয়ে রাশি রাশি তথ্যপ্রমাণ পাকিস্তানের হাতে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে যেমন রয়েছে লকভির যোগ নিয়ে ধৃত কাসভের স্বীকারোক্তি, তেমনই রয়েছে স্যাটেলাইট ফোনে কাসভ ও তার নয় সঙ্গীকে দেওয়া এই জঙ্গি নেতার লাগাতার নির্দেশের বেশ কিছু অডিও টেপ। লকভি সম্পর্কে বহু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন পাক ও মার্কিন গোয়েন্দারাও। দিল্লির অভিযোগ, এই তথ্যপ্রমাণ পাকিস্তান স্রেফ চেপে রেখেছে! এমনকী ভারত লকভির কণ্ঠস্বরের নমুনা হাতে তুলে দিলেও এই লস্কর জঙ্গি রাজি না হওয়ায় তার কণ্ঠস্বর রেকর্ডই করেনি পাকিস্তান! দিল্লির বক্তব্য, এ থেকেই স্পষ্ট, সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তানের সদিচ্ছার অভাব কতটা। ফলে সহজেই আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে লকভিরা।
গত ডিসেম্বরেও লকভিকে জামিন দিয়েছিল পাকিস্তানের একটি সন্ত্রাস-বিরোধী আদালত। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলে ফেরৎ পাঠানো হয়। ভারত চাইছে, এ বারেও তেমনই কোনও পদক্ষেপ করুক পাক সরকার। না হলে ভারত-বিরোধী জঙ্গি কার্যকলাপ নতুন গতি পাবে। শুক্রবার রাত পর্যন্ত পাক জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়নি লকভিকে। আদালতের নির্দেশ নিয়ে কিছু ‘টেকনিক্যাল’ কারণেই মুক্তি আটকে রয়েছে বলে সূত্রের খবর।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি, জেলে বন্দি অবস্থাতেও ভারত-বিরোধী কার্যকলাপে ভীষণ ভাবে তৎপর ছিল লকভি। বজায় ছিল তার জঙ্গি নেটওয়ার্কও। রাওয়ালপিন্ডির জেলে তাকে সব রকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হতো। ভারত এবং মার্কিন গোয়েন্দাদের অভিযোগ, পাক সেনার একাংশ ও পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের প্রথম সারির বহু কর্তা লকভির নিরাপত্তা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার দিকে নজর রাখতেন। জেল থেকেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লস্কর-ই-তৈবার প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত লকভি। মার্কিন গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের দাবি, জেলে থেকেও নিজস্ব নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে হাওলার মাধ্যমে লস্করের জন্য প্রায় ২৫ হাজার ডলার চাঁদা তোলে সে। সেই টাকা জঙ্গি কার্যকলাপে ব্যবহারও করা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই লকভির মুক্তি ভারতেরক উপর চাপ বাড়িয়েছে।
তবে শুধু মাত্র ভারতকে চাপে ফেলাই নয়, লকভিকে মুক্তি দেওয়ার পিছনে পাক সরকারের কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রাজনীতিও রয়েছে বলে অনুমান দিল্লির। দেশের মাটিতে পাকিস্তানের এখন সবথেকে বড় শত্রু ‘তেহরিক-ই-তালিবান’ (টিটিপি) জঙ্গিরা। গত ডিসেম্বরে এরাই পেশোয়ারের স্কুলে নির্বিচার গণহত্যা চালায়। এই সংগঠনটির সঙ্গে মতপার্থক্য রয়েছে পাক সরকারের মদতে পুষ্ট জঙ্গি নেতা হাফিজ সইদের সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার। যে সংগঠনের অন্যতম মাথা লকভি। টিটিপি-কে দমাতে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রণনীতি মেনেই লকভির প্রতি পাক সরকার আগাগোড়া নরম মনোভাব দেখিয়েছে বলে ধারণা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের। তাদের মতে, সম্ভবত টিটিপি-র বিরুদ্ধে লস্করকে ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে পাক প্রশাসনের। সে কারণেই লকভিকে মুক্তি দেওয়ার কৌশল।
কিন্তু আখেরে এই কৌশল কাজ করবে তো? ভারত মনে করে, এটা পাকিস্তানের জন্য ব্যুমেরাং হতে পারে। আজ পাক হাইকমিশনারকে এ কথাও বোঝানো হয়েছে যে, এক জন জঙ্গি শেষ বিচারে এক জন জঙ্গিই। ভাল বা মন্দ জঙ্গি বলে কিছু হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy