গরমের ছুটি পড়তেই ফি বছর ঘুরতে বেরোই আমরা। এ বারও বেরিয়ে পড়েছিলাম স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে। সঙ্গে কয়েক জন বন্ধু-বান্ধব। সব মিলিয়ে জনা দশেকের দল। যাব লাদাখ। শুনেছিলাম সেখানে পদে পদে চ্যালেঞ্জ। বিপদের হাতছানি। কিন্তু রাজ্যের সীমানা পেরোতেই উটকো বিপদ যে এ ভাবে হানা দেবে, তা ছিল আমাদের কল্পনার বাইরে।
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে রাজধানী ছেড়েছিল ঠিক সময়েই। সাড়ে দশটায় ধানবাদ পার হওয়ার আগে খাওয়া-দাওয়া শেষ। শুয়েও পড়েছিলাম উপরের বাঙ্কে। হাল্কা তন্দ্রা ছুটে গেল গুম গুম শব্দে। মনে হচ্ছে বাইরে যেন গুলি চলছে। যার ধাক্কায় কেঁপে উঠছে কামরার দেওয়াল। ছিটকে আসছে কাচের টুকরো। গয়ার ওই এলাকাটি মাওবাদীদের জন্য কুখ্যাত। সে রকম কোনও হামলা হল নাকি! দ্রুত আলো জ্বেলে নীচে তাকাতেই দেখি— দুম-দাম করে বাইরে থেকে পাথর ছিটকে আসছে কাচের জানলায়। কয়েক মুহূর্তেই কাচের জানলা ফেটে চৌচির। নীচের দু’দিকের দু’টি আসন ভরে গেল পাথর ও কাচে। ভাগ্যিস আমাদের নীচের আসন দু’টি গয়া পর্যন্ত খালি ছিল। তাই কারও বড় কোনও চোট লাগেনি। কিন্তু মাঝের আসনে শুয়ে থাকা আমার স্ত্রীর হাতে কাচের
টুকরো এসে লেগেছে। আর উল্টো দিকের বার্থে ভয়ে এক কোণায় সিঁটিয়ে গিয়েছে মেয়ে।
কী হল, কারা আক্রমণ করল, ভাল করে বোঝার আগেই সম্বিৎ ফিরল একটি বাচ্চা মেয়ের কান্নায়। আমাদের বি-২ কামরার একেবারে শুরুতে মায়ের সঙ্গে শুয়ে ছিল মেয়েটি। কাছে গিয়ে দেখি রক্তে ভেসে যাচ্ছে মা-মেয়ে। মেয়েটির আঘাত বেশি। শুনলাম, কাচের টুকরোর পাশাপাশি বাইরে থেকে ছোড়া পাথরের ঘা খেয়েছে সে। পাগলের মতো ট্রেনে চিকিৎসকের খোঁজে ছোটাছুটি করছেন মেয়েটির বাবা।
ইতিমধ্যে অন্য কামরাগুলো থেকে একই খবর আসতে শুরু করেছে। অনেকগুলো কামরার কাচের জানলাই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আহত হয়েছেন অনেকে। যাঁরা নীচে শুয়েছিলেন, তাঁরাই বেশি আঘাত পেয়েছেন। মিনিট দশেকের মধ্যে গয়া স্টেশন চলে এল। দুদ্দাড় করে ট্রেনে উঠলেন রেল পুলিশ ও রেলের অফিসারেরা। মেয়ের চিকিৎসার জন্য ট্রেন থেকে নেমে গেল ওই শিশুটির পরিবার। প্রাথমিক ভাবে কাচের জানলায় লাগানো হয় জোড়াতাপ্পি। প্রায় এক ঘণ্টা পরে ট্রেন ছাড়ল গয়া থেকে। মোগলসরাই স্টেশনে এসে ঠিক হল ভাঙা জানলা। কিন্তু আতঙ্কে-দুশ্চিন্তায় রাতভর জেগেই কাটালাম। সকাল সাড়ে দশটার জায়গায় সাড়ে এগারোটায় নয়াদিল্লি স্টেশনে পা দিয়ে হাঁফ ছাড়লাম আমরা। শেষ হল আতঙ্কের সফর।
আরও পড়ুন: ঝড়বৃষ্টিতে তিন রাজ্যে মৃত ৪৭
পরে জেনেছি, হামলার ঘটনাটি ঘটেছিল গয়ার ঠিক আগের স্টেশন মানপুরে। কোনও ট্রেন অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকায় ক্ষুব্ধ যাত্রীদের রাগের শিকার হয়েছিল আমাদের ট্রেনটি। জানলা লক্ষ্য করে ছোড়া হয়েছিল পাথর। তাদের ট্রেন সময়ে চলেনি সেটা রেলের বিষয়। আমরা যারা যাত্রী, আমাদেরই বা কী দোষ।
কী-ই বা দোষ করেছিল ওই সাত বছরের শিশুটি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy