Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

গুলজারের কবিতা

মূল উর্দু থেকে অনুবাদ: ইয়াসমিন নিগারচোখের ভিসার প্রয়োজন পড়ে না স্বপ্নের কোনও সীমানা নির্দিষ্ট নয় চোখ বন্ধ করে প্রতিদিন সীমান্তের ও পারে চলে যাই মেহেদি হাসানের সাক্ষাৎ পেতে।

গুলজার

গুলজার

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৬ ০৩:১৩
Share: Save:

চোখের ভিসার প্রয়োজন হয় না

চোখের ভিসার প্রয়োজন পড়ে না

স্বপ্নের কোনও সীমানা নির্দিষ্ট নয়

চোখ বন্ধ করে প্রতিদিন সীমান্তের ও পারে চলে যাই

মেহেদি হাসানের সাক্ষাৎ পেতে।

শুনেছি তাঁর স্বর আঘাত পেয়েছে

গজল নীরবতায় উপবিষ্ট তাঁর সামনে

কম্পিত ঠোঁট গজলের, যখন উচ্চারিত হয়

বইয়ের পাতায় জীর্ণ হয়েছে ফুল

বন্ধু ফারাজও বিদায় নিয়েছেন

‘হয়তো দেখা পাব তার

আবার স্বপ্নে’

বন্ধ চোখে অহরহ চলে যাই সীমান্তের ওপারে।

চোখের ভিসার প্রয়োজন পড়ে না

স্বপ্নের কোনও সীমান্ত যে হয় না।

কড়ানাড়ার শব্দ

খুব ভোরে স্বপ্ন যখন দরজায় কড়া নেড়ে গেল

দরজা খুলে দেখি সীমান্তের ও পার থেকে

কিছু অতিথি দাঁড়িয়ে, পরিচিত সবাই

সৎকারে অতিথির হাত পায়ে জল দিলাম

আঙিনায় আসন পাতা হল তাদের জন্য

মকাইয়ের মোটা রুটি উনুনে সেঁকে দিলাম

গত বছরের ফসলের কিছু গুড় পুঁটলিতে

করে নিয়ে এসেছিলেন অতিথি আমার

চোখ যখন খুলল আমার

দেখি ঘরে কেউ নেই

তবে দেখি উনুন তখনও নেভেনি

ঠোঁটে তখনও আমার গুড়ের মিষ্টি স্বাদ

বোধহয় স্বপ্ন ছিল

স্বপ্নই ছিল

তার পর শুনি সীমান্তে কাল রাতে

নাকি গুলি চলেছে, সীমান্তে কাল রাতে

শুনেছি কিছু স্বপ্ন খুন হয়েছে।

সীমান্তে এই নীরবতা কেন?

সীমান্তে কেন এই নীরবতা?

এই শীতল নিস্তব্ধতায় শিউরে উঠি

প্রতারক এই নীরবতা এক পায়ে দাঁড়িয়েও

মনোযোগী হয় এক চোখ

যে কোনও উত্তেজনার মুহূর্তে

সীমান্তের দু’পারেই দেখি

কন্টকাকীর্ণ শব্দের কিছু ক্যাকটাস অঙ্কুরিত হয়

সীমান্তের মরুভূমিতে

নিশ্বাস চেপে বয়ে যায় নীরব হাওয়া

মাটি ঘেঁষে তখন উড়ে যায় মরুঝড়

সীমান্তে কেন এই নীরবতা

এই শীতল নিস্তব্ধতায় এখন শিউরে উঠি।

টোবা টেক সিং

ওয়াঘায় গিয়ে টোবা টেক সিং-এর

বিষনের সঙ্গে দেখা করব আমি

শুনেছি সে এখনও ফুলে ওঠা এক পায়ে

সেখানেই দাঁড়িয়ে, যেখানে মান্টো

ছেড়েছিলেন তাঁকে, এখনও সে বিড়বিড় করে যাচ্ছে

‘উপর দি গুড়গুড় দি মুঙ্গ দি ডাল দি লালটেন-’

ঠিকানা চাই সেই উন্মাদের

যে উঁচু ডালের উপর বসে বলত

আল্লাহ্ই ঠিক করবেন কোন গাঁও কার

অংশে যাবে,

কবে সে নামবে তার ডাল থেকে,

তাকে জানাতে হবে এখনও কাটাছাঁটা, ভাগবাঁটোয়ারার

কাজ চলছে, সেই বিভাজন ছিল প্রাথমিক

এখনও যে বিভাজনের আরও কাজ বাকি।

আমায় ওয়াঘায় নিয়ে টোবা টেক সিং-এর

বিষনের সাক্ষাৎ পেতেই হবে,

আমায় খবর দিতে হবে তার বন্ধু আফজলের

সেই লহনা সিং, বুধওয়া সিং, সেই ভিন্ অমৃত

যারা খুন হয়ে এ পারে এসেছিল

যাদের গর্দান ছিল এক একটা সামগ্রী

যারা আগেই লুণ্ঠিত, তাদের যেন হত্যা করে সে

‘ভুরি’ কেউ আর দাবি করবে না।

সেই মেয়েটি প্রতি বছর এখন দৈর্ঘ্যে দ্রুত কমছে

যে মাসে মাসে একটু একটু করে বাড়ছিল,

খবর দিতে হবে সব পাগল এখনও গন্তব্যে পৌঁছয়নি

কিছু এ-পারে এবং কিছু ও-পারে এখনও পড়ে আছে

আমায় ওয়াঘা থেকে টোবা টেক সিং-এর বিষন

প্রতিনিয়তই বার্তা দিয়ে ডেকে পাঠায়

‘এর দি গুড়গুড় দি মুঙ্গ দি ডাল দি লালটেন দি

‘হিন্দুস্তান’ তে পাকিস্তান দি দুর ফিটে মু’।

চরকি

সবাই আমরা পালাচ্ছিলাম ছিন্নমূল হয়ে

মা তার সব গয়না নিয়েছিল সঙ্গে

কিছু বেঁধে, কিছু শরীরে প’রে

ছোট বোন আমার ছয় বছরের

তাকে পেটভরে দুধ খাইয়ে সঙ্গে নেওয়া হল

আমি আমার এক খেলনার চরকি ও

‘লাটু’ পাজামায় গুঁজে নিলাম

ভোরের আলো ফোটার আগেই

আমরা পালাতে চেয়েছিলাম

ছিন্নমূল হয়ে

আগুনের ধোঁয়া ও চিৎকার আর্তনাদের

জঙ্গল পেরিয়ে ধোঁয়া-আচ্ছন্ন হয়ে ছুটছিলাম আমরা

দেখি হাত কোনও ঝড়ের পেট থেকে চিরে আঁত বার

করতে ব্যস্ত

চোখ তার মুখ খুলে গর্জনে খানখান করছে রাতের

অন্ধকার

মা ছুটতে ছুটতে রক্তের বমি করল

আমার হাত থেকে কখন যে ফসকে গেল আমার বোনের

হাত, বুঝিনি

সে দিনই আমি সেখানে ফেলে এসেছিলাম

আমার শৈশব—

কিন্তু আমি সীমান্তের নীরবতার মরুভূমিতে

প্রায়ই দেখেছি

একটি চরকি এখনও মাটিতে নাচে

একটি ‘লাটু’ এখনও বনবন করে ঘোরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gulzar poetry
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE