Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
FAKE NEWS

ভুয়ো খবর এবং উত্তরসত্য যুগ— সুশীল সমাজের জেগে ওঠার সময় আগত

আমরা সবাই সত্য শব্দটির অর্থ জানি। কিন্তু আমাদের মধ্যে কজন পোস্ট-ট্রুথ বা উত্তর সত্যের মানে জানে? আপনিও জানেন কি?

ভুয়ো খবরের ভিড়ে আসল খবর চাপা পড়ে যায় অনেক সময়।

ভুয়ো খবরের ভিড়ে আসল খবর চাপা পড়ে যায় অনেক সময়।

উজ্জ্বলকুমার চৌধুরী এবং সুনয়ন ভট্টাচাৰ্য
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৫:৩৮
Share: Save:

কিছুদিন আগেই ভুয়ো খবর রুখতে হোয়াটসঅ্যাপ একটি নতুন পদক্ষেপ করেছে। কোনও বার্তা ফরওয়ার্ডেড হলে তাতে forwarded লেবেল থাকবে যাতে গ্রাহক বুঝতে পারেন যে বার্তাটি প্রেরক তৈরি করেননি। কিন্তু এই যে আমরা ভুয়ো খবর সম্পর্কে এত ভাবিত, আমরা কি কোনওদিন বোঝার চেষ্টা করেছি যে ভুয়ো খবর কী বা কেন? বোধহয় না। চলুন আমরা অনুধাবন করার চেষ্টা করি, ভুয়ো খবরের পিছনে মেকানিজমটি কী?

আমরা সবাই সত্য শব্দটির অর্থ জানি। কিন্তু আমাদের মধ্যে কজন পোস্ট-ট্রুথ বা উত্তর সত্যের মানে জানে? চলুন প্রথমে, আমরা পোস্ট-ট্রুথ বা উত্তর সত্য ধারণাটিকে বোঝার চেষ্টা করি। সহজ ভাষায়, উত্তর সত্য এমন একটি অনভিপ্রেত পরিস্থিতি যেখানে মূল সত্যকে খারিজ করা হয় ও ব্যক্তিগত মতামত এবং আবেগনিষ্ঠ ধারণাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এমন একটি পরিস্থিতিতে জনমতও এই উত্তর-সত্যের ওপরে ভিত্তি করেই গঠিত হয়।

একই ভাবে উত্তর-সত্য রাজনীতি বলেও একটি প্রাসঙ্গিক তত্ত্ব আছে। ওই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিতর্ক মূলত আবেগনির্ভর হয় এবং তথ্য ও সত্যকে ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করা হয়। এখানে বলে রাখা ভাল, মিথ্যে তথ্য সরবরাহ করা এবং উত্তর-সত্যের মধ্যে একটি মৌলিক তফাৎ আছে। প্রথম ক্ষেত্রে মিথ্যা সত্যকে প্রতিস্থাপন করে, কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সত্যকে খোলাখুলি দ্বিতীয় শ্রেণীতে নির্বাসিত করা হয়। তাই উত্তর-সত্য মিথ্যা থেকে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর এবং শক্তিশালী। ২০১৬ সালে অক্সফোর্ড অভিধান পোস্ট-ট্রুথ শব্দটিকে বছরের শ্রেষ্ঠ শব্দ হিসেবে নির্বাচন করেছিল।

আরও পড়ুন: মোদী সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ত’ বলায় গ্রেফতার মহিলা গবেষক

বিশ্বাস এবং সমষ্টিগত ধারণাতে পরিবর্তন আনতে ইচ্ছাকৃত ভুয়ো সংবাদ পরিবেশন করেন একাংশ।

২০১৫ সালে গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ জেসন হার্সিন উত্তর-সত্য রাজনীতির নিরিখে একটি সুন্দর শব্দ বাক্যাংশ সৃষ্টি করেছিলেন – রেজিম অফ পোস্ট-ট্রুথ, যা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় উত্তর-সত্য শাসন। হার্সিনের মতে কিছু বিশ্বব্যাপী অভিসারী ঘটনা উত্তর-সত্য সমাজের সূচনা করেছে। এই ঘটনাসমূহের মধ্যে প্রধান হচ্ছে সমাজের কিছু সংখ্যক মানুষকে লক্ষ্য করে মিথ্যে খবর এবং গুজব প্রচার করা যাতে তাঁদের বিশ্বাস এবং সমষ্টিগত ধারণাতে পরিবর্তন আনা যায়। আধুনিক এবং কেন্দ্রীভূত গণমাধ্যমের বিভক্ত হওয়া, ব্যবহারকারী-উৎপাদিত বিষয়বস্তু, সত্যি এবং মিথ্যার মধ্যে তফাৎ নির্ণয়ের অক্ষমতা এবং সামাজিক মাধ্যমের বহুল ব্যবহার। আজকে সার্চ ইঞ্জিনগুলো ঠিক সেই তথ্যসমূহ ওপরে রাখে যা মানুষ চায়। সত্যের উপরে তাই আর কোনো গুরুত্ব আরোপ করা হয় না। আজ গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের পরে প্রশ্ন উঠছে। প্রত্যেকটি সংবাদ সংস্থা কোনও না কোনও ভাবে খবরের বিকৃতি ঘটাচ্ছে – কেউ বা অন্য জায়গা থেকে খবর চুরি করছে, কেউ বা খবরের নামে প্রচার করছে আর কেউ বা মিথ্যে খবর ছড়াচ্ছে। তাই নিউজ ভ্যালুজ নামক শব্দটা একটি প্রহসনে পরিণত হয়েছে।

এবারে আমরা ভুয়ো খবর বোঝার চেষ্টা করে দেখতে পারি। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে ভুয়ো খবর বা পেক নিউজ এবং মিথ্যা খবর বা ফলস নিউজ দুটো স্বাধীন ব্যাপার। আমরা যখন ভুয়ো খবর শব্দটা ব্যবহার করি তখন ধরে নেওয়া হয়, একটা সত্যিকারের খবরকে ভুয়ো খবরে পরিবর্তিত করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা এখানে মিথ্যে খবরের ওপরে জোর দিচ্ছি – যে ক্ষেত্রে হয় একটি খবরকে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে অথবা খবরটির কলেবর একদমই অন্যরকম ছিল।

আজকের ডিজিটাল সংস্কৃতিতে যে কোনও মানুষ নিজের মতামত একটি কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের সাহায্যে প্রকাশ করতে পারে। সামাজিক মাধ্যমের সৌজন্যে গেটকিপিং বলে আজকে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মিথ্যার ওপরে ভিত্তি করে সৃষ্ট মতামত, নিবন্ধও ফেসবুক এবং টুইটারের সাহায্যে আপামর জনসাধারণের সামনে সত্যি বলে প্রমাণিত হচ্ছে। এতে যে খবর সবচাইতে বেশি চলছে সেই খবরকেই সত্যি বলে ধরে নেওয়ার একটি ভয়ঙ্কর প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইন্টারনেটের সাহায্যে মানুষ ঠিক সেই খবরগুলোই গ্রহণ করছে যা তাঁরা গ্রহণ করতে চায়। তাই এতে সবাই নিজেদের মতামতই পুষ্ট করছে। আবার এখানে আবেগের কাছে সত্য পরাস্ত।

আরও পড়ুন: হায়দরাবাদ জোড়া বিস্ফোরণ কাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত দুই, বেকসুর খালাস দুই

আজকের উত্তর-সত্য রাজনীতির যুগে ‘গো-পাচারকারীদের’ গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, প্রত্যেকটি হিন্দু-মুসলমান বিবাহকে ‘লভ-জিহাদ’-এর রূপ দেওয়া হচ্ছে, কেউ পুনরায় হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করলে ‘ঘর ওয়াপসি’ বলা হচ্ছে, একটি বিশেষ সেনা আইনকে কোনও মানুষ প্রশ্ন করলে তাঁকে দেশবিরোধী বলা হচ্ছে, দারিদ্র থেকে মুক্তির ডাককে দেশ ভাঙার ডাক হিসেবে দেখা হচ্ছে, একান্তই মানবিক কারণে প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সাথে দেখা করাকে সামাজিক মাধ্যমে কঠোরভাবে নিন্দা করা হচ্ছে এবং তাঁকে বোরখা-পরিহিত দেখানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, যখন ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ একটি আন্ত-ধর্মীয় বিবাহিত যুগলের পাসপোর্ট-সংক্রান্ত সংকটের সুরাহা করেন, তখন ইন্টারনেট সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণী তাঁকে তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করে।

প্রচারের মোকাবিলা করা

আন্তর্জাতিক স্তরে গুজবের তত্ত্বানুসন্ধান করার জন্য ছ’টি তথ্য যাচাই সংগঠন আছে (snopes.com, politifact.com, factcheck.org, truthorfiction.com, hoax-slayer.com, and urbanlegends.about.com)। সাধারণত একটি গুজবের শিরোনাম, মূল বক্তব্য এবং রায় (সত্য না মিথ্যা দুই-ই) পরীক্ষা করা হয়। তদন্তের ফলাফল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

সরকার এবং একাধিক প্রযুক্তিভিত্তিক সংগঠন উত্তর-সত্য রাজনীতির সঙ্গে লড়ার আন্তরিক চেষ্টা করছে। গ্লোবাল পলিসি নামক গবেষণা পত্রিকাতে অধ্যাপক নায়েফ আল-রোধান চার রকমের পদ্ধতি সম্বন্ধে লিখেছেন:

সত্য যাচাই করার প্রযুক্তিগত সরঞ্জামসমূহের উন্নতি সাধন করতে হবে। বিজ্ঞানীদের আরও সক্রিয় হতে হবে। সরকারকে আরও ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। এখানে মনে রাখা দরকার, সরকারের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করার অন্য নাম নয়। ভুয়ো খবরকে সনাক্ত করতে হবে। ভুয়ো খবরের বিরুদ্ধে ‘টিকা’ একটি কার্যকরী মনস্তত্ত্বিক সমাধান।

ভারতবর্ষ পৃথিবীর সবচাইতে বৃহৎ ইন্টারনেট বাজারগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশেও ভুয়ো খবর একটি গুরুতর সমস্যা। এই দেশে ভুয়ো খবরকে রোধ করতে অনেকগুলো পদক্ষেপ করা হয়েছে। আমরা কিছু উদাহরণ এখানে নিতে পারি। The Quaint Webqoof নামে একটা অধ্যায় শুরু করেছে যা ভুয়ো খবরের পর্দাফাঁস করে। ভুয়ো খবরের বিরুদ্ধে যে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ভারতবর্ষে শুরু হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে (১) গোবিন্দরাজ এথিরাজের Boom FactCheck (BFC), (২) পঙ্কজ জৈনের Social Media Hoax Slayer (SMHS), (৩) প্রতীক সিনহার Altnews.com এবং (৪) check4spam.com, যার কর্ণধার হচ্ছে শাম্মাস ওলিয়াথ এবং বালকৃষ্ণ বিড়লা।

আরও পড়ুন: দাঁড়িয়ে থেকে সৎ মেয়েকে গণধর্ষণ করাল মা, উপড়ানো হল চোখ

ভুয়ো সংবাদের জেরে হানাহানি, খুনোখুনির ঘটনাও ঘটে।

কিছু দিন আগে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যার ফলে আমরা ভুয়ো খবরের ক্ষমতা সম্বন্ধে সম্যক ভাবে জানতে চাই। হঠাৎ করে খবর রটে, পাকিন্তানে নাকি ভারতবর্ষের দুজন সেনার গর্দান নেওয়া হয়েছে। এই খবর রটার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক হাজার হোয়াটস্যাপ গ্রুপ সৃষ্টি হয়। একটি ভিডিও ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে যায় যেখানে দেখানো হয়, একজন সেনাকে করাত দিয়ে কাটা হচ্ছে এবং অন্য আরেক জনকে ছুরি দিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হচ্ছে। এ-ও দেখানো হয়, দুজন সেনানীই মৃত্যুর সময় বন্দে মাতরম গাইছিল। এক সপ্তাহ পরে প্রমাণিত হয় যে ভিডিওটি ২০১১ সালের এবং যাদের খুন করা হচ্ছিল, তাঁরা স্পেনীয় মাদকদ্রব্য পাচারকারী। SM Hoax Slayer-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং মুম্বইয়ের ব্যবসায়ী পঙ্কজ জৈন এই প্রশংসনীয় কাজটি করেন।

পুলিশ তথ্য অনুযায়ী হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার জন্য ২০১৫ সালে গুজরাতের আমদাবাদ শহরে একজন ব্যক্তিকে পিটিয়ে মারা হয় এবং নিকটবর্তী গাঁধীনগরে চার ব্যক্তিকে প্রহার করা হয়। উত্তরপ্রদেশে মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে মারা হয় যখন স্থানীয় গ্রামের লোকেরা হোয়াটসঅ্যাপে কিছু ছবি দেখে যা প্রমাণ করে যে আখলাক একটি গরুকে হত্যা করেছিল। পরে ফরেনসিক রিপোর্ট প্রমাণ করে যে আখলাক যে মাংস ব্যবহার করেছিল তা গোমাংস ছিল না। গত তিন মাসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ৩০এর থেকে বেশি মানুষকে পিটিয়ে মারা হয়েছে ছেলেধরা অপবাদে। প্রত্যেকটি ঘটনার পিছনে কারণ ছিল ভুল হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা।

বিশেষজ্ঞদের মতে ভুয়ো খবর প্রধানত দুই প্রকারের হয় – খবর এবং ভিডিও যা বিভিন্ন ওয়েবসাইট, টুইটার হ্যান্ডল, ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে ছড়ায় এবং হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ড মেসেজ যা খুব দ্রুত ছড়িয়ে যায়।

কিন্তু, কী করে এই খবর যাচাই সংস্থাগুলো ভুয়ো খবর নির্ধারণ করে? ইউটিউবের ক্ষেত্রে নানান সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। কি-ওয়ার্ডসগুলোকে গুগলে বিপরীতদিকে অনুসন্ধান করে আসল প্রসঙ্গ উন্মোচন করা হয়। Altnews-এর প্রতীক সিংহ এভাবে ব্যাখ্যা করেন, “কোনো কোনো সময়ে আমি ভিডিওগুলোকে ফ্রেম অনুযায়ী বিভক্ত করি এবং তারপরে আসল ভিডিওর অনুসন্ধান করি। এই কাজটি করতে এক ঘন্টা বা একদিন – যে কোনও সময় লাগতে পারে|”

বিশিষ্ট তথ্য বিজ্ঞানী ঋষভ শ্রীবাস্তবের মতে ভারতের ক্ষেত্রে ভুয়ো খবরের প্রভাব খুব বেশি। কারণ বেশিরভাগ ভুয়ো খবরই হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়ায়। তথ্য বিশ্লেষণের সাহায্যে এটা নিরূপণ করা সম্ভব যে একটি বিশেষ ভুয়ো খবর যারা ছড়াচ্ছে তাঁদের লিঙ্গ বা জাতিগত বৈশিষ্ট কী। কিন্তু শ্রীবাস্তব মনে করেন যে হোয়াটসঅ্যাপ এনক্রিপশনের দরুণ এটা করা খুবই দুরূহ।

আরও পড়ুন: ‘দলিত’ শব্দ ব্যবহারে না, নির্দেশ কেন্দ্রের

যে বা যারা ভুয়ো খবর সৃষ্টি করে তাঁদের একটি খুব প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে যে কোনও ছবিকে তার মূল প্রসঙ্গ থেকে বিচ্যুত করা। চুরি করা ভেজাল ছবির সাহায্যে তৈরি করা ভুয়ো খবর সত্যিকারের সামাজিক অশান্তি টেনে আনতে পারে। ভারতেও আমরা কিছু অদ্ভুত দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। একটি বিশেষ ভুয়ো খবর দাবি করেছিল যে একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দিরে আধুনিক প্রযুক্তির প্রমাণ পাওয়া গেছে – যেমন একটি মহাকাশচারীর ছবি । আরেকটি ভুয়ো খবর বলেছিল, বিজ্ঞানীরা নাকি মহাভারতের ঘটোৎকচের ৮০-ফুট লম্বা কঙ্কাল বের করেছে।

ভুয়ো খবর নিরূপণ করতে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের বিপরীত সার্চ ইঞ্জিনগুলো সম্বন্ধে অবহিত হতে হবে। একটা উদাহরণ হচ্ছে TinEye। বিপরীত সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে একটি ছবির উৎস খুঁজে পাওয়া সম্ভব। একবার উৎস সন্ধান করলে ছবিটিতে কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে তা-ও নিরূপণ করা সম্ভব। প্রতীক সিংহ এক একটি ভিডিওকে ফ্রেমে বিভক্ত করেন এবং তার পরে বিপরীত সার্চ ইঞ্জিনে ফেলে দেখেন। SHMSএ এটা প্রকাশিত হয়েছিল যে মন্দিরের গাত্রে মহাকাশচারীর ছবিটা আসলে সালামাঙ্কার নিউ ক্যাথিড্রালের। মহাকাশচারী এবং অন্যান্য আধুনিক পরিবর্তনগুলো ১৯৯২ সালে চার্চটির পুন:প্রতিষ্ঠার সময়ে হয়েছিল। ঘটোৎকচের কঙ্কালটি আসলে একজন ইতালিও শিল্পীর তৈরী ভাস্কর্য।

ছবি যে শুধুমাত্র চুরি করা হয় তা না, ছবিগুলো পরিবর্তিতও করা হয়। দুটো ঐতিহাসিক ছবির মেলবন্ধনে তৈরী হয়েছিল একটি সংকর ছবি যাতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদস্যদের ইংল্যান্ডের রানীকে কুর্নিশ করতে দেখা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: উচ্ছৃঙ্খলতা নয় ব্যক্তিগত জীবনেও, বার্তা বিপিনের

সোশ্যাল সাইট থেকেই ছড়ায় বেশির ভাগ ভুয়ো খবর।

যে সংস্থাগুলো ভুয়ো খবর নিরূপণ করে তাঁরা সচরাচর সামাজিক মাধ্যমে (যেমন ফেসবুক অথবা টুইটার) যাচাই করা প্রোফাইল ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এই ব্যবস্থাও অব্যর্থ নয়। অনেক সময় নাম করা রাজনীতিক অথবা সাংবাদিকও অসাবধানতাবশত ভুয়ো খবর নিজেদের প্রোফাইলে ছড়িয়ে থাকেন। কিন্তু এই পদ্ধতিতে সাধারণত একটি ভুয়ো খবর ছড়ানোর পেছনে সূক্ষ্ম কারণ নির্ণয় করা যায়।

অনেক সময় ভুয়ো খবর যাচাই করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছেও প্রশ্ন করা যেতে পারে। যেমন Boom FactCheckএর এথিরাজ এবং জ্যাকবের মতে স্থানীয় ব্যাপারে পুলিশ যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। যখন রাজস্থানে একটি হিংস্র অপহরণের খবর ছড়িয়ে পড়ে, Boom FactCheck ঠিক এই ভাবেই খবরের সত্যতা যাচাই করেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্যের প্রয়োজন আরও একটি সাম্প্রতিক ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়। গুরুগ্রামে একটি স্কুল বাসে হামলা চালায় কিছু দুষ্কৃতী। বাসটি লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারা হয়। সকলে জানত, যে কাজটি শ্রী রাজপুত করণী সেনা নামক একটি দক্ষিণপন্থী দল করেছে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে একটি বিশেষ লবি প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে কাজটি মুসলমানেরা করেছিল। গুরুগ্রাম পুলিশ কিন্তু এই তত্ত্বকে অস্বীকার করে।

যতই ভয়ঙ্কর হোক, ভুয়ো খবর ভারতবর্ষের জন্য একটি বিশেষ সমস্যা। ঝাড়খণ্ডে সর্বমোট সাতজন মানুষ প্রাণ হারায় সামাজিক মাধ্যমে গুজবের জন্য। ঝাড়খন্ড ঘটনার দুই মাস পরে বিজেতা মালিক নাম্নী পশ্চিমবঙ্গের একজন বিজেপি নেত্রী মানুষকে উস্কানোর জন্য একটি ছায়াছবি থেকে ভিডিও ব্যবহার করে। ভিডিওটিতে কয়েকজন মুসলমান একজন মহিলার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করছিলো। এই ভিডিওটি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। হোয়াটসঅ্যাপে একাধিক ভিডিও ছড়ানো হয় যেখানে দেখানো হয় যে ভারতীয় মুসলমানেরা ক্রিকেট খেলায় পাকিস্তানের জয়ে উল্লাস প্রকাশ করছে। এই ভিডিওগুলির মধ্যে শুধু একটি সঠিক ছিল এবং সেই ভিডিওটিও কাশ্মীরের।

আরও পড়ুন: ‘লং মার্চ’-এর চাষিরাই নায়ক দিল্লির মিছিলে

এখানে আমাদের ভুয়ো খবরের মনস্তাত্বিক দিকটি নিয়ে ভাবতে হবে। আসলে এই ভুয়ো খবরগুলো পক্ষপাতদুষ্ট মানুষের অহং পরিতৃপ্ত করে। এই কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে মূলধারার মিডিয়া যাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়ানো। তা সত্বেও এই মূলধারার মিডিয়াই ভুয়ো খবরের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়ে চলেছে। মানুষ এখনও গণমাধ্যমকে দুটো ভাগে বিভক্ত করে – একটি ভাগ খবর যোগায় আর একটি ভাগ বিনোদনের প্রয়োজন মেটায়। যে সংস্থাগুলো খবর সরবরাহ করে, তাঁদের উপরে অপরিসীম দায়িত্ব মানুষকে শিক্ষিত করার। একটি সম্পাদকীয় এবং একটি খবরের মধ্যে তফাৎ বোঝানো আজকে খুবই জরুরি।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে ভুয়ো খবর এবং উত্তর-সত্যকে রুখতে হলে সাংবাদিক এবং শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজকেও হতে হবে সংবেদনশীল এবং সজাগ। আমি এবং আপনিই পারি এই ভয়ঙ্কর পথ থেকে সমাজকে ফিরিয়ে নিয়ে আনতে।

(লেখকদ্বয় শিক্ষাবিদ। মতামত নিজস্ব )

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস

(দেশজোড়া ঘটনার বাছাই করা সেরা বাংলা খবর পেতে পড়ুন আমাদের দেশ বিভাগ।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE