Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

আমরা ছিলাম প্রাতর্ভ্রমণের সঙ্গী: প্রণব মুখোপাধ্যায়

যাঁর সঙ্গে এতটাই দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, তিনি চলে যাওয়ার মুহূর্তে কোনও তাত্ত্বিক মূল্যায়ন করা খুবই কঠিন কাজ।

ভারতরত্ন: তৎকালীন রাষ্ট্রপতির হাত থেকে। ২০১৫-য়। —ফাইল চিত্র।

ভারতরত্ন: তৎকালীন রাষ্ট্রপতির হাত থেকে। ২০১৫-য়। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৮ ০৪:০৫
Share: Save:

আশির দশকের গোড়ায় টানা চার-পাঁচ বছর পাশাপাশি দু’টি বাড়িতে থেকেছি আমরা। বাড়ি পাশাপাশি, কিন্তু দু’টি রাস্তার নাম আলাদা। আমি থাকতাম যন্তরমন্তর রোডে আর অটলবিহারী বাজপেয়ী রাইসিনা রোডে। দু’জনেরই ছিল সকালে হাঁটার অভ্যাস, তাই বছরের পর বছর ছিলাম একে অন্যের প্রাতর্ভ্রমণের সঙ্গী। আগের দিনই হয়তো সংসদে দ্বৈরথ হয়েছে, ভোরবেলা আবার দু’জনে একসঙ্গে! এমনই এক ব্যক্তিগত সখ্য ভাগ করে নিয়েছি দশকের পর দশক। যে সখ্য ছিল পারিবারিকও। খেতে খুব ভালবাসতেন। আমার স্ত্রী গীতা (শুভ্রা) মাঝে মাঝেই রান্না করে পাঠাত।

যাঁর সঙ্গে এতটাই দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, তিনি চলে যাওয়ার মুহূর্তে কোনও তাত্ত্বিক মূল্যায়ন করা খুবই কঠিন কাজ। আমরা রাজনৈতিক বিরোধী ছিলাম, বহু বিষয়ে আমাদের মতবিরোধ ছিল। যেমন ওঁর বিদেশনীতির আমরা ঘোষিত বিরোধী। সেটাই তো স্বাভাবিক। অটলজি বলতেন ‘প্রকৃত জোট নিরপেক্ষতা’র কথা। উনি দাবি করতেন, ইন্দিরা গাঁধীর জোট নিরপেক্ষতা ‘সোভিয়েত ঘেঁষা’। আমরা স্বভাবতই তাঁর এই বক্তব্যের বিরোধিতা করতাম।

তবে একটা কথা আগেও বলেছি, আজও বলতে চাই যে, উনি ছিলেন সর্বার্থে প্রকৃত বিরোধী নেতা। প্রবল গন্ডগোল পাকিয়ে সংসদ বানচাল করার রেওয়াজ তখন এমনিতেও ছিল না। বারবার আমি বলেছি যে এটা সংসদীয় কানুনের মধ্যে পড়ে না। বাজপেয়ীও সেটাই বিশ্বাস করতেন। ভাষার উপর অসামান্য দখল ছিল তাঁর। এ রকম বাগ্মী বক্তার অধিবেশনে বিরোধিতা করার জন্য গন্ডগোল পাকানোর দরকারও হতো না। যুক্তি দিয়ে ধীরে ধীরে তিনি নিজের বক্তব্য প্রকাশ অথবা বিপক্ষের অবস্থানকে খণ্ডন করতে পারতেন। সংখ্যা তাঁর পক্ষে থাক বা না থাক, তিনিই ছিলেন আমার চোখে দেখা সেরা বিরোধী নেতা। আশির দশকে অনেক বার ওঁর সঙ্গে সংসদে বাগ্‌যুদ্ধ হয়েছে আমার, নয়ের দশকেও হয়েছে। সেই যুদ্ধেও যেন একটা আনন্দ ছিল। কিন্তু ২০০৪-এ লোকসভায় হেরে যাওয়ার পর বিশেষ মুখ খুলতেন না। অনেকটাই যেন মৌন হয়ে গিয়েছিলেন শেষ দিকটা।

আরও পড়ুন: ওঁর স্মিত হাসিই চিরদিনের স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে: আডবাণী

আজ সন্ধ্যায় খবরটি পাওয়ার পরে ওঁর মেয়েকে চিঠি লিখে জানিয়েছি আমার শোক। লিখেছি যে, বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক মননধারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন অটলজি। এক দিকে বিরোধী রাজনৈতিক পরিসরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সামলেছেন। অন্য দিকে, কঠিন সময়ে পরম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন। নেতৃত্বের সর্বোচ্চ ঐতিহ্যের কিছুটা আত্মস্থ করেছেন, কখনও কিছুটা নিজেই তৈরি করেছেন।

আরও পড়ুন: শ্রীঅটলবিহারী বাজপেয়ী (১৯২৪-২০১৮)

আজ বহু স্মৃতি ভিড় করে আসছে। ২০০১-এ সংসদে জঙ্গি হানার সময়ে বাজপেয়ী ঠিক আছেন কি না জানতে তাঁকে ফোন করেছিলেন সনিয়া গাঁধী।বাজপেয়ী পরে বলেন, যে দেশে প্রধানমন্ত্রীর জন্য এ ভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিরোধী দলনেত্রী, সে দেশে গণতন্ত্র চিরকাল বজায় থাকবে! বিদেশমন্ত্রী থাকার সময়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে যে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছি, সেই দলে ছিলেন অটলজি। একসঙ্গে নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলাম। উনি প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে সেরা সাংসদের খেতাব নিয়েছি ওঁর হাত থেকেই।

আজ অটলজির প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে একটা যুগ শেষ হয়ে গেল। বহুকাল যে যুগকে মানুষ মনে রাখবে।

(দেশজোড়া ঘটনার বাছাই করা সেরা বাংলা খবর পেতে পড়ুন আমাদের দেশ বিভাগ।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pranab Mukherjee Atal Bihari Vajpayee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE